হজরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী
“আমি-তোমাকে-সমস্ত-সৃষ্টির-জন্য-শুধু-রহমতস্বরূপ-পাঠিয়েছি।”
(সূরাহ আল-আম্বিয়া’– ১০৭)
“তিনিই-(আল্লাহ্)-যিনি-তাঁর-রাসূলকে-হেদায়াত-ও-সত্য-দ্বীন-সহকারে-পাঠিয়েছেন-যাতে-তিনি-একে-সকল-দ্বীনের-ওপর-বিজয়ী-করে-দেন-যদিও-মুশরিকরা-তা-পছন্দ-করে-না।”
আমরা
আমাদের প্রিয় মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবন সম্পর্কে জানব। কারণ আল্লাহ্ তা'আলা
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মাধ্যমেই ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে পাঠানো সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী তিনি তাঁর অনুসারীদের জীবনের ওপর যেরূপ প্রভাব বিস্তার করেছেন মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোন ব্যক্তিই তেমনটি পারেন নি।
তাঁর জীবন আমাদের অনুসরণের জন্যে সর্বোত্তম নমুনা (উওয়াতুন
হাসানাহ)। তিনিই আমাদেরকে তাঁর আমলের দ্বারা দেখিয়েছেন কিভাবে বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা
ও রব আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্য করতে হবে।
আল্লাহ্ তা'আলা কুর'আন মজীদে এরশাদ করেন; “বল-(হে-মুহাম্মাদ!)-তোমরা-যদি-আল্লাহকে-ভালবাস-তাহলে-আমাকে-অনুসরণ-কর।
ফলে-আল্লাহ্-তোমাদেরকে-ভালবাসবেন-ও-তোমাদের-গোনাহগুলো-ক্ষমা-করে-দেবেন।-আর-আল্লাহ্-ক্ষমাশীল-মেহেরবান।” (সূরাহ আলে ইমরান- ৩১)
এর
মানে হচ্ছে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যেভাবে ইসলামের অনুসরণ করেছেন আমরা ঠিক সেভাবেই ইসলামের
অনুসরণ করলেই আল্লাহ্ তা'আলা আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। আর আল্লাহ্ তা'আলা কুর'আন মজীদে
তাঁকে (সমস্ত সৃষ্টির জন্যে রহমত) বলে উল্লেখ করেছেন। (সূরাহ আল-আম্বিয়া’-
১০৭)
কুর'আন-মজীদের-ঘোষণা-অনুযায়ী-হযরত-মুহাম্মাদ-(সাঃ)-এর-কর্তব্য-ছিল-সকল-জীবনব্যবস্থার-ওপর-ইসলামের-প্রাধান্য-প্রতিষ্ঠা-করা (সূরাহ আছ্ছাফ্- ৯)। অন্য কথায় আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে পাঠানো সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কর্তব্য ছিল সমাজের বুকে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা ও মিথ্যাকে অপসারণ করা।
তাই মুসলমান হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য হচ্ছে আমরা
যে সমাজে বসবাস করি সেখানে আল্লাহ্ তা'আলার আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা ও সকল প্রকার অন্যায়
ও পাপাচার উৎখাতের জন্য কাজ করা। আর একেই বলে জিহাদ- যে সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা
করেছি।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, তিনি-ওহীর-মাধ্যমে-আল্লাহ্-তা'আলার-নিকট-থেকে-হেদায়াত-লাভ-করতেন,-কিন্তু-আমাদের-নিকট-ওহী-নাযিল-হয়-না। (সূরাহ আল-কাহ্- ১১০) তিনি ছিলেন-আল্লাহ্-তা'আলার-পাঠানো-সর্বশেষ-নবী। (সূরাহ আল আহযাব- ৪০) হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) শুধু একজন নবীই ছিলেন না, তিনি একজন মানুষও ছিলেন।
তিনি কোন
অতিমানবিক সত্তা ছিলেন না, বরং একজন মরণশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এমন
ব্যতিক্রমধর্মী ও অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন যা তাঁকে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে
শ্রেষ্ঠতম মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তাঁকে সকলের জন্যে অনুসরণীয় প্রোজ্জ্বল
নমুনায় পরিণত করেছে।
শৈশবের স্মৃতি
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর পুরো
নাম
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) ৫৭১ খৃস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল প্রত্যুষে আরবের মক্কাহ নগরীতে সম্ভ্রান্ত
কুরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। 'মুহাম্মাদ' নামের অর্থ ‘প্রশংসিত’। তাঁর পুরো নাম হচ্ছে;
আবু-আল-কাসিম-মুহাম্মাদ-ইবনে-আবদুল্লাহ-ইবনে-আবদুল-মুত্তালিব-ইবনে-হাশিম
শৈশবের স্মৃতি হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পিতা ‘আবদুল্লাহ তাঁর জন্মের আগেই ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর মা আমিনাহ ইন্তেকাল করেন। তাঁর জন্মের কয়েক দিন পরেই তাঁকে হালিমার নিকট লালন-পালন করতে দেয়া হয়। হালিমা তাঁকে পাঁচ বছর লালন-পালন করেন।
এরপর তাঁকে তাঁর মায়ের নিকট ফিরিয়ে দেন। ঐ সময় সন্তান জন্মের পর বুকের দুধ পান করানো ও লালন-পালনের জন্যে অন্য মহিলাদের বিশেষ করে বেদুইন মহিলাদের নিকট দেয়া কুরাইশ গোত্রের মধ্যে প্রচলিত রীতি ছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) (Hazrat Muhammad SAW) এর মাতা ইন্তেকাল করলে তাঁর দাদা 'আবদুল মুত্তালিব তাঁকে লালন-পালন করেন।
শৈশব কালের প্রথম দিক থেকেই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)
একের পর এক মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হন। তাঁর বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন তাঁর দাদা ইন্তেকাল
করেন। অতঃপর তাঁর চাচা আবু তালিব তাঁকে লালন-পালন করতে থাকেন। আবু তালিব ছিলেন কুরাইশ
গোত্রের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী।
সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফর
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালিবের স্নেহ-মমতা ও আদর-যত্নে লালিত-পালিত হতে থাকেন।
তাঁর বয়স যখন বার বছর তখন তিনি চাচার সাথে এক ব্যবসায়িক সফরে আশ্-শামে যান। উল্লেখ্য,
আশ্-শাম বলতে বৃহত্তর সিরিয়াকে বুঝায়। তাঁদের কাফেলা যখন বুম্বায় গিয়ে পৌঁছে তখন
সেখানে বসবাসরত বাহীরা নামক এক খৃস্টান সন্ন্যাসী তাঁদেরকে রাতের খানা খাবার জন্যে
দাওয়াত দেন।
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জন্ম তারিখ
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখকগণ তাঁর জন্মের সন সম্পর্কে বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। কেউ ৫৬৯ খৃষ্টাব্দে, আবার কেউ ৫৭০ খৃস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল প্রত্যুষে বলেছেন। আমার নিকট ‘আল্লামা শিবলী নু'মানী কর্তৃক তাঁর 'সীরাতুন্নবী গ্রন্থে উল্লেখিত ৫৭১ খৃষ্টাব্দ সঠিক মনে হয়েছে।
এটা
ছিল একটা ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। ইতিপূর্বে আবু তালিব ও তাঁর কাফেলা বহুবার ঐ পথ দিয়ে
যাতায়াত করেছেন। কিন্তু কখনোই এ সন্ন্যাসী তাঁদেরকে দাওয়াত করেন নি হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ) ছাড়া কাফেলার সকল লোকই সেখানে রাতের খানা খেতে যান। সম্ভবতঃ মালপত্র ও উটগুলোর
দেখাশোনা করার জন্যে তিনি থেকে যান। তখন বাহীরা তাঁকে খেতে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করলে
তিনিও খেতে আসেন।
পরে বাহীরা তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন করলে তিনি এসব প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত অথচ সঠিক জবাব দেন। বাহীরা ছিলেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি খৃস্টধর্ম ও তাঁদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল (Bible) সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। তাই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর প্রশ্নগুলোর যে জবাব দেন তা থেকে বাহীরা বুঝতে পারেন যে, এই বালক মুহাম্মাদ (সাঃ) ভবিষ্যতে নবী হবেন।
তিনি আবু তালিবকে
তাঁর ভাতিজার প্রতি বিশেষভাবে যত্ন নেয়ার জন্যে পরামর্শ দেন। তাই আবু তালিব তাঁর ব্যবসায়ের
কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আর মোটেই দেরী না করে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে সাথে নিয়ে
মক্কায় ফিরে আসেন।
রাখাল বালক বেশে নবীজী
(সাঃ)
হযরতমুহাম্মাদ (সাঃ) ছোটবেলা দুম্বার (মেষ) পালের দেখাশুনা করতেন। দুম্বা চরানোর সময় তিনি তাঁর পারিপার্ষিক অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তা করতেন। তিনি দুম্বার পাল নিয়ে আরবের বিশাল মরুর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। এর ফলে তিনি বিশাল প্রকৃতি দেখার সুযোগ পেতেন। তিনি আল্লাহ্ তা'আলার সৃষ্টি বিস্ময়কর প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতেন।
তিনি
বাল্যকালে যে রাখাল বালক হিসেবে দুম্বা চরাতেন তাঁর জীবনের এ অধ্যায় সম্বন্ধে তিনি
গর্ব করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “আল্লাহ্ এমন কোন নবীকে পাঠান নি যিনি কখনোই রাখাল
ছিলেন না। মূসা (আঃ) একজন রাখাল ছিলেন, দাউদ (আঃ) ও একজন রাখাল ছিলেন।'
এর কারণ হয়ত এই ছিল যে, আল্লাহ্ তা'আলা চাচ্ছিলেন, তাঁর নবী-রাসূলগণ (আঃ) রাখাল হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করুন যাতে তাঁরা আল্লাহর বাণী প্রচার করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে আচরণ করতে পারেন।
একপাল দুম্বা, ভেড়া, ছাগল, উটকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ। কারণ এ প্রাণীগুলো ডান-বাম, ভাল-মন্দ কিছুই বুঝে না। তাই এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে অপরিসীম ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। নবী-রাসূলগণ (আঃ) রাখালের কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা তাঁদের প্রকৃত দায়িত্ব পালনে অর্থাৎ আল্লাহর বাণী প্রচারে খুবই উপকারী প্রমাণিত হয়।