হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনী
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনী- ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী আন্দোলনের সূচনা ওহী নাযিলের সাথে সাথে
আল্লাহর রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ভূমিকা শুরু হল। তিনি তাঁর বাকী জীবনে যে ইসলামী আন্দোলন চালিয়ে যান তারও সূচনা হয় এখান থেকেই। তাঁর এ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি ছিল তিন বছরের অর্থাৎ ৬১০ খৃস্টাব্দে প্রথম ওহী নাযিল হওয়ার পর থেকে ৬১৩ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত।
প্রথম দিকে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কেবল তাঁর বন্ধু-বান্ধব, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন বিশেষভাবে বিশ্বাস করার মত লোকদের নিকট আল্লাহর বাণী প্রচার করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত খাদীজা (রাঃ)-ই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন।
এরপর হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর চাচাত
ভাই হযরত ‘আলী (আবু তালিবের
পুত্র) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি হলেন ইসলাম গ্রহণকারী
দ্বিতীয়
ব্যক্তি। তৃতীয় হলেন
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ক্রীতদাস
হযরত যায়েদ বিন হারিসাহ। হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বন্ধুদের
মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন হযরত আবু
বকর। তিনি ছিলেন একজন
ব্যবসায়ী।
পর পর চারজন লোক হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনলেন। তাঁদের পরিচিতি এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে তাঁদের সম্পর্কের বিষয়টি লক্ষ্য করার মত। তাঁরা হলেন; প্রথম- তাঁর স্ত্রী খাদীজা, দ্বিতীয় তাঁর চাচাত ভাই আলী, তৃতীয়- তাঁর ক্রীতদাস যায়েদ ও
চতুর্থ-তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু
সম্মানিত ব্যবসায়ী আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু
'আন্হুম)। তাঁদের প্রত্যেকেই
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর খুবই
কাছের মানুষ, তাঁর প্রিয়জন- যারা
তাঁকে ভালভাবে জানতেন। তাঁরা কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই ইসলাম গ্রহণ করেন।
হযরত আলী
(রাঃ)
এর
ইসলাম গ্রহণ
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চাচাত ভাই হযরত ‘আলী (রাঃ) যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনার মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
আল্লাহ্ তা'আলা হযরত জিবরাঈল (আঃ)-কে পাঠিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ‘উযূ ও নামাজ আদায়ের নিয়ম শিখিয়ে দেন। এরপর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তা হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে শিখিয়ে দেন এবং সে নিয়ম অনুযায়ী তাঁরা নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন।
বালক হযরত ‘আলী
(রাঃ) তখন হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ) ও তাঁর স্ত্রী
হযরত খাদীজা (রাঃ)কে রুকূ‘-সিজদাহ করতে ও কুর'আন তিলাওয়াত করতে
দেখলেন। এ ব্যতিক্রমী দৃশ্যটি
তাঁর নিকট খুবই ভাল
লাগল। তাই নামাজ শেষ
হলে তিনি হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ)-এর নিকট এ
সম্বন্ধে জানতে চাইলেন, “আপনারা কার উদ্দেশে সিজ্দাহ করলেন?”
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “আমরা আল্লাহর উদ্দেশে সিজদাহ করেছি যিনি আমাকে নবী করে পাঠিয়েছেন এবং লোকদেরকে তাঁর দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে আদেশ করেছেন৷ ”এরপর হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হযরত 'আলীকে আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে এবং তাঁর ওপরে যে বাণী নাযিল হয়েছে তা গ্রহণ করার জন্যে দাওয়াত দিলেন।
এছাড়া তিনি ইতিমধ্যেই কুরআনের
যেসব আয়াত নাযিল হয়েছিল তা থেকে কয়েকটি
আয়াত তেলাওয়াত করে শুনালেন।
এতে
হযরত 'আলী (রাঃ) নিজের
মধ্যে খুব আবেগ-উত্তেজনা
অনুভব করলেন। তিনি কয়েক মুহূর্ত
চিন্তা করলেন, তারপর বললেন যে, তিনি এ
ব্যাপারে তাঁর পিতার সাথে
আলোচনা করবেন।
হযরত
'আলী (রাঃ) অত্যন্ত আবেগ-উত্তেজনা, অস্থিরতা ও চিন্তার মধ্য
দিয়ে রাত কাটালেন। তিনি
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দাওয়াত
সম্পর্কে ভাবলেন।
পরদিন
সকালে তিনি হযরত রাসূলুল্লাহ
(সাঃ)-এর নিকট গেলেন
এবং ইসলামে ঈমান আনার কথা ঘোষণা
করলেন। তিনি বললেন, “আল্লাহ্
আমার পিতা আবু তালিবের
সাথে পরামর্শ না করেই আমাকে
সৃষ্টি করেছেন। তাহলে আমি কেন আল্লাহর
ইবাদাত করার ব্যাপারে তাঁর
সাথে আলোচনা করব?”
বালক বয়সে হযরত 'আলী (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ কিশোর-তরুণদের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় ঘটনা। এ ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের উচিত এ পৃথিবীর জীবনকে প্রকৃতই অর্থবহ ও লক্ষ্যের অভিসারী করে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামের জন্যে কাজ করা।
নিঃসন্দেহে এটাই হচ্ছে প্রকৃত শান্তি ও সুখী জীবনের পথ। প্রথম মুসলিম বালক হযরত ‘আলী (রাঃ) এই শান্তির পথ ইসলামকে বেছে নিয়েছিলেন।
প্রথম যুগের
উল্লেখযোগ্য
মুসলমানগণ
হযরত রাসূলুল্লাহ
(সাঃ)
ইসলাম প্রচার শুরু করার পর
সেই প্রথম যুগে ইসলাম প্রচারের
প্রাথমিক পর্যায়ে অল্প সংখ্যক লোক
ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে এদের মধ্যে
বেশ কয়েকজন পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত হন। আপনাদের জানার জন্যে এখানে তাঁদের নাম উল্লেখ করা
হল।
প্রাথমিক যুগের মুসলিম পুরুষদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন:
হযরত ‘আলী
বিন
আবি
তালিব,
হযরত
যায়েদ
বিন
হারিসাহ,
হযরত
আবু
বকর
বিন
আবি
কুহাফাহ,
হযরত 'উছমান বিন আফফান, হযরত সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস, হযরত আবদুর রহমান বিন ‘আওফ, হযরত তালহা বিন উবাইদিল্লাহ, হযরত আবু যার আল-গিফারী, হযরত যুবাইর বিন আল-'আওয়াম, হযরত আবু ‘উবাইদাহ বিন আল-জাররাহ, হযরত আকাম বিন আবিল্-আরকাম আল-মাখযুমী (যিনি আকাম বিন আবৃদি মানাফ বিন আসাদ নামেও পরিচিত),
হযরত
সুহাইব
আর-রুমী,
হযরত
'আব্দুল্লাহ
বিন
মাস'উদ,
হযরত
খাব্বাব
বিন
আল-আরাত্,
হযরত
‘উছমান
বিন
মাযউন,
হযরত
জা'ফার
বিন
আবি
তালিব
ও
হযরত
নু'আইম
বিন
‘আব্দুল্লাহ
(রাদিয়াল্লাহু
তা'আলা
'আনহুম)।
এযুগে
ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে মহিলারাও পিছিয়ে ছিলেন না। ইসলামের প্রাথমিক
পর্যায়ে যেসব মহীয়সী মহিলা
ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁরা হচ্ছেন:
হযরত
খাদীজা
বিনতে
খুয়াইলিদ,
হযরত
ফাতিমাহ
বিতিল-খাত্তাব,
হযরত
আসমা
বিনতে
আবি
বাকর,
হযরত
ফাতিমাহ
বিতিল
মুজাল্লিল,
হযরত
ফুকাইহাহ
বিনতে
ইয়াসার,
হযরত
আসমা
বিনতে
উমাইস,
হযরত
আসমা
বিনতে
সালামাহ,
হযরত
রাল্লাহ
বিনতে
আবি
'আওফ
ও
হযরত
হুমাইনাহ
বিনতে
খালাফ
(রাদিয়াল্লাহু
তা'আলা
'আনহুন্না)।
প্রথম পর্যায়ের
সমাপ্তি
ইসলামী
আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)
বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন লোককে ইসলামের দাওয়াত দেন। ফলে ধীরে
ধীরে মক্কার সকল বয়সের লোকদের
মধ্যে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ইসলামের বিস্তার ঘটতে থাকে।
মক্কার
লোকদের মধ্যে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)
ও তাঁর প্রচারিত বাণী
আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। শুরুতে তারা
বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়
নি। তারা মনে করে
যে, মুসলমানদের মনে একটা উদ্ভট
কল্পনা জেগেছে এবং তা খুব
শীঘ্রই দূর হয়ে যাবে;
শেষ পর্যন্ত মূর্তি-পূজার বিজয় হবে।
তিন বছর পার হয়ে গেল। মক্কাহ উপত্যকার প্রায় সর্বত্র আল্লাহর বাণীর প্রচার অব্যাহত থাকল।
ইসলামী আন্দোলন প্রকাশ্য রূপ নিল
প্রথম
ওহী নাযিল হবার তিন বছর
পর আল্লাহ্ তা'আলা হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি
হুকুম নাযিল করলেন:
“যা-তোমাকে-আদেশ-করা-হয়েছে-তা-প্রকাশ্যে-ঘোষণা-করে-দাও-এবং-মুশরিকদের-দিক-থেকে-মুখ-ফিরিয়ে-নাও।”(সূরাহ আল-হিজ্র্-
৯৪)
এ
ছিল প্রকাশ্যে ও খোলাখুলিভাবে লোকদেরকে
আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার
নির্দেশ। এটা ছিল
ইসলামী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়- প্রকাশ্য পর্যায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নৈশভোজে ‘আলী (রাঃ)-এর ঘোষণা I
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর পক্ষ
থেকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ লাভের পর সম্ভাব্য নতুন
পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও
ঈমান সহকারে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে নৈশভোজের আয়োজন করলেন। খানাপিনা শেষ হবার পর
তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বললেন:
“হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধরগণ! আমি এমন কোন আরবের কথা জানি না যে তার আপন লোকদের নিকট আমার চেয়ে উত্তম বাণী নিয়ে এসেছে। আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু নিয়ে এসেছি যা ইহকালের জন্যেও সর্বোত্তম, পরকালের জন্যেও সর্বোত্তম। আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।