হজের ইতিহাস
হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। হজ হচ্ছে সুনির্দিষ্ট
সময়ে মক্কাহ্ শরীফের কা'বাহ্ ঘরের
তাওয়াফ (চারদিকে পরিক্রমণ) ও তার নিকটবর্তী
'আরাফাত নামক স্থানে অবস্থানসহ
কতগুলো বিধিবদ্ধ কাজ আঞ্জাম দেয়ার
নাম। হজের সফরে যাওয়ার জন্যে
শারীরিক ও আল-কা'বাহ-মক্কাহ শরীফে 'আল্লাহর ঘরে’ যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য আছে এমন প্রতিটি
মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য
জীবনে একবার হজ করা ফরয।
হজ করতে
কত
দিন
লাগে
ইসলামী
বর্ষপঞ্জীর দ্বাদশ মাস যুলহিজ্জাহর ৮
থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত
ছয়দিন
ব্যাপী
হজ্জের অনুষ্ঠানাদি উদযাপিত হয়। (সূরাহ আলে ইমরান-৯৭)
হজের ইতিহাস
মক্কাহ্
শরীফে অবস্থিত পবিত্র গৃহ আল্-কা'বাহ্ 'বাইতুল্লাহ' (আল্লাহর ঘর)
নামেও পরিচিত। কা'বাহ্ হচ্ছে
এমন একটি একতলা ভবন
যার
দৈর্ঘ্য,
প্রস্থ
ও
উচ্চতা
সমান। এটি মূলতঃ
হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর
পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)
নির্মাণ করেছিলেন। শুধু আল্লাহ্ তা'আলার ‘ইবাদাতের জন্যে নির্মিত এটিই প্রথম গৃহ।
(সূরাহ আলে ইমরান-৯৬)
আল্লাহ্ তা'আলা কা'বাহকে বরকতময় করেছেন। যে সব মুসলমান হজ্জের সমর্থ্যের অধিকারী তাঁরা প্রতি বছর সারা দুনিয়া থেকে হজ্জের জন্য মক্কাহ শরীফে এসে সমবেত হন। প্রকৃত অর্থে হজ্জ হচ্ছে মুসলমানদের বার্ষিক আন্তর্জাতিক সমাবেশ (Annual International Muslim Assembly)।
হজ্জের সময় ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চিত্র বিশেষভাবে ফুটে ওঠে এবং এতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে এক নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তা অনুভব করতে পারেন। এখানে ভাষা, অঞ্চল, বর্ণ ও গোত্রের ব্যবধান দূর হয়ে যায় এবং ঈমানের বন্ধন সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান লাভ করে।
আল্লাহর
ঘরে সকলেই একই মর্যাদার অধিকারী।
তাঁদের সকলেই আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে হাযির হন। এখানে রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, মালিক
ও চাকরের মধ্যে কোন তফাত থাকে
না। সকলেই আল্লাহ্ বান্দাহ এবং সকলেরই একই
বৈশিষ্ট্য।
হজ্জের
অনুষ্ঠানমালার মধ্যে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর
মধ্যে রয়েছে:
- ১। ইহরাম পরিধান করা (সূরাহ আল্-বাকারাহ-২০০) অর্থাৎ হজ্জের জন্যে নির্ধারিত পোশাক পরিধান করা।
- ২। কা'বার চারদিকে সাতবার তাওয়াফ করা। (সূরাহ্ আল্- বাকারাহ-২০০)
- ৩। কা'বা নিকট ছাফা ও মারওয়াহ নামক দু'টি পাহাড়ের মাঝে দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করা যাকে সা'ঈ বলা হয়। (সূরাহ্ আল্-বাকারাহ-১৫৮)
- ৪। 'আরাফাহ, মুযদালিফাহ ও মিনায় গমন ও অবস্থান (সূরাহ আল্-বাকারাহ-১৯৮)
- ৫ ৷ মিনায় তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে কঙ্কর নিক্ষেপ করা (সূরাহ আল্-বাকারাহ-২০০)
- ৬। মাথা মুড়ানো বা চুল ছোট করা। (সূরাহ আল্-বাকারাহ-২০০)
- ৭। পশু কুরবানী করা। (সূরাহ আল্-বাকারাহ-১৯৬, ২০০)
হজ্জের মওসুমে একজন হজ্জযাত্রী যখন মক্কা শরীফের উদ্দেশে রওয়ানা হন তখন কয়েকটি সুনির্দিষ্ট স্থানের কোন একটিতে পৌঁছার পূর্বে তাঁকে ইহরাম পরিধান করতে হয়। এ জায়গাগুলোকে মীকাত (স্টেশন) বলা হয়। পুরুষদের জন্য ইহরাম হচ্ছে দুই খণ্ড সেলাইবিহীন সাদা কাপড়।
একজন
হজ্জযাত্রী অন্য সময় তাঁর দৈনন্দিন জীবনে যে পোশাক পরিধান করেন তার পরিবর্তে তাঁকে
অত্যন্ত সাদাসিধা ধরনের এ পোশাক পরিধান করতে হয়।
মহিলাদের ওমরা পালনের নিয়ম
তবে
মহিলাদের জন্যে তাঁদের সাধারণ মামুলী পোশাকই হচ্ছে ইহরাম। এই পরিবর্তনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পোশাকের এই পরিবর্তন হজ্জযাত্রীকে আল্লাহ্ মোকাবিলায় তার মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে
দেয়। তিনি তার সৃষ্টিকর্তার একজন বাধ্যগত দাস। এ পোশাক তাকে আরো স্মরণ করিয়ে দেয়
যে, মৃত্যুর পরে তাকে কয়েক খন্ড সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে এবং তার প্রিয় দামী
পোশাক পরিচ্ছদ পড়ে থাকবে।
ইহরাম
পরিধান করার সময় হজ্জযাত্রীকে হজ্জের নিয়্যত করতে হয় । তাঁকে মনে মনে বলতে হয়:
“আমি হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম পরিধান করছি।” মুখে বলতেও বাধা নেই। ইহরাম পরিহিত অবস্থায়
হজ্জযাত্রীর জন্য কতগুলো বিধিনিষেধ রয়েছে। তাঁকে এগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। ইহরাম
অবস্থায় নীচের কাজগুলো নিষিদ্ধ:
হজের নিষিদ্ধ কাজ সমুহ
- ক) সুগন্ধি ব্যবহার করা।
- খ) কোন কোন প্রাণীকে, এমনকি মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গকে হত্যা করা বা আঘাত করা।
- গ) গাছ-পালা ও উদ্ভিদ ভাঙ্গা বা উপড়ানো।
- ঘ) শিকার করা।
- ঙ) বিবাহ করা বা বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা।
- চ) অসততামূলক বা গুনাহের কোন কাজ করা।
- ছ) অস্ত্র বহন করা।
- জ) মাথা ঢাকা (পুরুষদের)।
- ঝ) মুখ ঢাকা (মহিলাদের)।
- ঞ) গোড়ালীঢাকা জুতা পরা।
- ট) চুল বা নখ কাটা।
- ঠ) যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা।
নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য
- দৈনন্দিন জীবনের ভোগ-বিলাসিতা ভুলে যেতে সহায়তা করা।
- এ সত্য অনুভব করা যে, সব কিছুই আল্লাহর।
- হিংস্রতা বা আগ্রাসী প্রবণতাকে দমন করা ও প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা অনুভব করা।
- দয়া-অনুগ্রহের অনুভূতি সৃষ্টি।
- স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ভুলে যাওয়া ও আল্লাহর চিন্তায় ডুবে থাকা।
- আল্লাহর বান্দাহর ন্যায় আচরণ করা।
- আক্রমণাত্মক মনোভাব পরিত্যাগ করা।
- বিনয় বৃদ্ধি করা।
- একটি পবিত্র পরিবেশ অনুভব করা।
- সাদামাটা জীবনের প্রকাশ ঘটানো।
- প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ না করার মনোভাব প্রকাশ করা।
- দুনিয়ার ভোগ-আনন্দ ভুলে যাওয়া।
এসব বিধিনিষেধ একজন হজ্জযাত্রীকে আল্লাহ্ সম্পর্কে ও তাঁর জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্থাৎ মৃত্যুপরবর্তী জীবনে সাফল্য সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং অন্য কোন কিছুর সম্পর্কে চিন্তা না করতে উদ্বুদ্ধ করে। ইহরাম অবস্থায় হজ্জযাত্রীকে তালবীয়াহ্ পড়তে হয়। তালবীয়াহ্ হচ্ছে:
হজের দোয়া
“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা
লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্-নি'মাতা লাকা ওয়াল্
মুলক, লা শারীকা লাক্।”
“আমি হাযির, হে আল্লাহ্! আমি হাযির, আমি
হাযির, তোমার কোন শরীক নেই, আমি হাযির। অবশ্যই সকল প্রশংসা ও নি'আমাত তোমারই, আর রাজত্ব-সার্বভৌমত্বের
মালিকও তুমিই, তোমার কোন শরীক নেই।"
হজের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস
হজ্জযাত্রীরা
যে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কা'বাহর দক্ষিণ দিকে অবস্থিত
যমযম কুপ থেকে পানি পান। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর স্ত্রী ও হযরত ইসমা'ঈল (আঃ)-এর মাতা
হযরত হাজর (রনি) (আঃ) শিশু ইসমাঈল (আঃ)-এর জন্য পানির সন্ধানে ছাফা-মারওয়াহ পাহাড়ের
মাঝে দৌড়াদৌড়ি করার সময় এ কূপটি আবিষ্কার করেন। (আমাদের দেশে হযরত হাজিরাকে 'বিবি
হাজেরা' বলা হয়)।
হজ ২০২৪ আপডেট বাংলাদেশ
বস্তুতঃ নামাজ, যাকাত ও রোজার যেসব শিক্ষা রয়েছে তার সবই হজ্জে রয়েছে। আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে আমরা কেন নামাজ আদায় করি, যাকাত দেই ও রোজা পালন করি। আমরা আল্লাহকে স্মরণ করার জন্যে নামাজ আদায় করি, তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যে যাকাত দেই এবং কেবল তাঁরই জন্যে রোজা পালন করি।
নামাজ আদায়ের সময় আমরা দৈনিক পাঁচ বার আল্লাহ্ তা'আলার সামনে হাযির হই, কিন্তু হজ্জের সময় আমাদেরকে সর্বক্ষণই আল্লাহ্ তায়ালার সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়। নামাজেরসময় আমাদেরকে কা'বার দিকে মুখ করতে হয়।
কিন্তু হজ্জের সময় আমরা সশরীরে কা'বার সামনে হাযির থাকি। যাকাত আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমাদের সঞ্চিত সম্পদের একটি অংশ জনকল্যাণমুলক ও অন্যান্য ভাল উদ্দেশ্যে ব্যয়ের শিক্ষা দেয়। আর হজ্জের সময় আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এর চেয়ে অনেক বেশী অর্থ ব্যয় করে থাকি।
ওমরা করার
নিয়ম
হজ্জের মওসুম ছাড়া অন্য সময় দুনিয়ার যে কোন অংশের যে কোন মুসলমান কা'বাহ্ যিয়ারত করতে আসতে পারেন। একে ‘ওমরা (সূরাহ আল্-বাকারাহ-১৮৫) বলা হয়। প্রচলিত কথায় 'ছোট হজ্জ' বলা হয়। যিনি “উমরাহ করবেন তাঁকে ইতিপূর্বে উল্লেখকৃত হজ্জের করণীয়সমূহের মধ্য থেকে ১,২,৩, ও ৬ নম্বর কাজ করতে হয়।
অর্থাৎ তাঁকে
ইহরাম
পরিধান,
কা'বাহ
তাওয়াফ, সা'ঈ ও
মাথামুণ্ডন
বা
চুল
ছোট
করতে
হয়। রোজা আমাদেরকে
দিনের বেলা পানাহার, ধুমপান
ও যৌন সংসর্গ থেকে
বিরত রাখে। অন্যাদিকে ইহরাম আমাদের ওপর আরো অনেক
বিধিনিষেধ আরোপ করে (যদিও
ইহরাম অবস্থায় পানাহার করা নিষিদ্ধ নয়)।
হজ্জের
সময় এসব আনুষ্ঠানিকতা ও
বিধিনিষেধ থেকে আমরা কি
শিক্ষা লাভ করি? আমরা
এ শিক্ষা লাভ করি যে,
আমরা আল্লাহর নিকটই ফিরে যাব এবং
আমরাদেরকে অবশ্যই তাঁর আদেশ-নিষেধসমূহ
মেনে চলতে হবে। আমরা
যদি তাঁর আদেশ-নিষেধসমূহ
মেনে চলি তাহলে দুনিয়ার
জীবনে ও পরকালের জীবনে
আমরা অবশ্যই সফল হব ইনশাআল্লাহ্।
পোস্ট ট্যাগঃ