আখেরি নবীর জীবনী
নবীর জীবনের কাহিনী-হযরত
মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনীতে জানা যায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে
দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ লাভের পর সম্ভাব্য নতুন
পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও
ঈমান
(iman) সহকারে
নিজেকে প্রস্তুত করলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে নৈশভোজের আয়োজন করলেন। খানাপিনা শেষ হবার পর
তিনি সবাইকে সম্বোধন করে বললেন:
“হে আবদুল মুত্তালিবের বংশধরগণ! আমি এমন কোন আরবের কথা জানি না যে তার আপন লোকদের নিকট আমার চেয়ে উত্তম বাণী নিয়ে এসেছে। আমি আমাদের জন্য এমন কিছু নিয়ে এসেছি যা ইহকালের জন্যেও সর্বোত্তম, পরকালের জন্যেও সর্বোত্তম।
আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর দিকে দাওয়াত
দেয়ার জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তখন কিশোর হযরত
‘আলী (রাঃ) (Hazrat Ali
(RA)) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন: আমি
আপনার সাহায্যকারী হব। যে-ই
আপনার বিরোধিতা করবে আমি তাকে
জানের দুশমন গণ্য করে তার
বিরুদ্ধে লড়াই করব।” এতে বয়স্ক লোকেরা
অট্টহাসি হাসল। তারপর যে যার পথে
চলে গেল ৷
ছাফা পাহাড়ের
ওপর মুহাম্মাদ
(সাঃ)
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) (hazrat muhammad saw) এবার মক্কাবাসীদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলেন। তিনি ছাফা পাহাড়ের ওপর উঠে মক্কাবাসীদেরকে ডাক দিলেন। যারা তাঁকে দেখতে পেল তারা ছাফা পাহাড়ের (Chafa hill) নীচে এসে সমবেত হল।
হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ) তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন: “হে
কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! আমি যদি বলি
যে, আমি পাহাড়ের ওপাশে
একটি শত্রুবাহিনীকে দেখতে পাচ্ছি যারা আমাদের ওপর
হামলা চালাবে, তাহলে কি তোমরা আমার
কথা বিশ্বাস করবে?” জবাবে তারা বলল: “হ্যা,
অবশ্যই। কারণ আমরা তোমাকে
বিশ্বাস করি এবং তোমাকে
কখনো মিথ্যা বলতে দেখিনি ৷”
তখন
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন: “তাহলে
জেনে রাখ, আমি একজন
সতর্ককারী এবং আমি আমাদেরকে
কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি।
হযরত মুহাম্মদ
সাঃ
এর
বংশধর
হযরত
মুহাম্মদ সাঃ এর বংশধরের
মধ্যে ছিলেন; হে বানু 'আদিল
মুত্তালিব!
হে
বানু
‘আদি
মানাফ!
হে
বানু
যুাহ!
হে
বানু
তাইম!
হে
বানু
মাম!
হে
বানু
আসাদ!
আল্লাহ্ আমাদেরকে- আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে সতর্ক করার জন্যে আমাকে
আদেশ করেছেন। আমি আমাদেরকে এ
মর্মে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তোমরা যদি
ঘোষণা কর যে, আল্লাহ্
ছাড়া আর কোন ইলাহ্
নেই; তাহলে ইহকালে ও পরকালে তোমরা
কল্যাণের অধিকারী হবে।"
একথা
শুনে তাঁর চাচা আবু লাহাব ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে চীৎকার করে
বলল: “আজকেই তোমার দুই হাত ধ্বংস
হয়ে যাক। তুমি এজন্যই
কি আমাদেরকে জমায়েত করেছ?” অপেক্ষা
করছে তা ওহী মারফত
তাঁকে জানিয়ে দিলেন। আল্লাহ তা'আলা আল কুরআনে (Quran)
এরশাদ করেন: আরবী শব্দের বাংলা অর্থ নিচে দেওয়া
হলোঃ
সূরা লাহাব
এর
শানে
নুযুল
বা বাংলা অর্থ
“আবু-লাহাবের-দুই-হাত-ধ্বংস-হোক-এবং-সে-নিজেও-ধ্বংস-হোক-।-তার-ধন-সম্পদ-ও-সে-যা-উপার্জন-করেছে-তা-তাকে-এ-থেকে-রক্ষা-করতে-পারবে-না-।-সে-খুব-শীঘ্রই-শিখাযুক্ত-আগুনে-(জাহান্নামে)-পৌঁছে-যাবে,-আর-তার-জ্বলানী-কাঠ-বহণকারিনী-স্ত্রীও-যার-গলায়-খেজুর-পাতার-রশি-থাকবে।”-(সূরাহ-আল-লাহাব-১-৫)
হযরত
মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন কাহিনীতে মক্কার লোকদেরকে
প্রকাশ্যেই আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়ার
সাথে সাথেই তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে
শত্রুতামূলক আচরণ শুরু হয়ে
গেল। এ সময় থেকে
ইসলামী আন্দোলনের প্রথম যুগের অনুসারীরা অত্যন্ত সাহসিকতা, দৃঢ়তা ও ধৈর্যের সাথে
এ শত্রুতা ও বিরোধিতার মোকাবিলা
করেন। বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা'আলার সন্তুষ্টির
জন্যে এ ধরনের ত্যাগ-তিতিক্ষার দৃষ্টান্ত খুব কমই চোখে
পড়ে।
মুহাম্মদ সাঃ এর জীবন
কাহিনীতে নির্যাতনের ঘটনা
মক্কাবাসীরা এর আগে ইসলামের এ আন্দোলনের প্রতি তেমন কোন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রকাশ্যে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলে তারা তাঁর তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। তারা ইসলামকে তাদের পৌত্তলিক ধর্মের প্রতি হুমকি বলে মনে করতে লাগলো। অন্যদিকে তারা দেখতে পেল যে, ইসলাম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই তারা ইসলামের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর জন্যে ইসলামের অনুসারীদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করল।
ঐ সময় প্রতিদিনই ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। এ কারণে মুসলমানদের প্রতি মূর্তিপূজকদের আক্রোশ আরো তীব্রতর হতে লাগল। কুরাইশরা প্রথমে আবু তালিবের মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করল। তারা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে আর পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়ার জন্যে তাঁকে অনুরোধ করল। এ উদ্দেশ্যে কুরাইশ গোত্রের প্রভাবশালী লোকদের দু'-দু'টি প্রতিনিধিদল দুইবার আবু তালিবের সাথে সাক্ষাত করে।
তিনি শান্তভাবে তাদের কথা শুনলেন এবং কিছু সান্ত্বনামূলক কথাবার্তা বলে তাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। আবু তালিব ছিলেন কুরাইশদের নেতা এবং একই সাথে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর চাচা। একারণে কুরাইশরা তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তাই আবু তালিব হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ডেকে বললেন যে, তিনি যেন এমন কিছু না করেন যাতে তাঁর ওপর বেশী চাপ সৃষ্টি হয়।
এটা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জন্য একটা কঠিন পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু তিনি এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন: “ হে আমার চাচা! আল্লাহর শপথ! তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় এবং আমাকে আমার এ দাওয়াতী মিশন পরিত্যাগ করতে বলে তবু আমি কিছুতেই তা পরিত্যাগ করব না যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ্ এ মিশনকে বিজয়ী করেন বা আমি এ কাজ করতে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই।”
আবু তালিব হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দৃঢ়তা
দেখে অভিভূত হয়ে যান এবং
বলেন: “যাও, তুমি যা
খুশী তা-ই করতে
পার। আল্লাহর কসম, আমি কখনোই
তোমার ওপর থেকে আমার
সমর্থন প্রত্যাহার করব না। ”
মক্কার কাফিরদের হাতে সর্বপ্রথম যে মুসলমান নির্যাতন ভোগ করেন তিনি হচ্ছেন হযরত সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)। একবার হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে এক পাহাড়ী উপত্যকায় নামাজ আদায়কালে ইসলামের দুশমনরা তাঁদের ওপর হামলা চালায়।
এতে হযরত সা'দ
বিন্ আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)
তলোয়ারের আঘাতে আহত হন। আরেকবার
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কা'বাহ
ঘরের নিকটে ইসলামের প্রচার করার সময় কাফিরদের
দ্বারা আক্রান্ত হন। এ সময়
হযরত
হারিস
বিন
আবি
হালাহ্
আক্রমণকারী জনতাকে থামাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু কাফিররা তাঁর ওপর হামলা
করে ও তাঁকে হত্যা
করে। তিনি হচ্ছেন ইসলামের
জন্যে শাহাদাত বরণকারী প্রথম মুসলমান।
হযরত বেলাল
রাঃ
এর
জীবনী
সংক্ষিপ্ত
এছাড়া এ সময় ইসলাম গ্রহণকারী আবিসিনীয় ক্রীতদাস হযরত বেলাল রাঃ-এর ওপর তাঁর মালিক অমানুষিক অত্যাচার চালায়। তাঁকে কড়া রোদে মরুভূমির বুকে আগুনের মত উত্তপ্ত বালুর ওপরে শুইয়ে তাঁর বুকের ওপর একটি ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়।
অন্য
কোন কারণে নয়, কেবল ইসলাম
গ্রহণের কারণেই তাঁর ওপর এ
নির্যাতন চালানো হয়। হযরত বিলাল
(রাঃ) অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে এ নির্যাতন
সহ্য করেন এবং বলতে
থাকেন “আল্লাহ্ (Allah)
এক
আল্লাহ্
এক।”
কাফিররা
তাঁকে ঈমান
থেকে কুফরে ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়।
এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর
(রাঃ) তাঁকে নির্যাতন থেকে বাঁচাবার জন্যে
এগিয়ে আসেন। তিনি হযরত বিলাল
(রাঃ) কে তাঁর কাফির
মালিকের নিকট থেকে কিনে
নিয়ে মুক্ত করে দেন।
ঐ সময় আরো যেসব মুসলমান কাফিরদের হাতে নির্যাতন ভোগ করেন তাঁরা হচ্ছেন: হযরত 'আম্মার, হযরত আবু ফুকাইহাহ, হযরত সুহাইব আর-রূমী ও হযরত খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু তা'আলা 'আহুম)। কাফিররা এমন কি মুসলমান মহিলাদের ওপরও নির্যাতন চালায়।
এ সময় যে সব
মুসলিম মহিলা নির্যাতনের শিকার হন তাঁরা হচ্ছেন:
হযরত
সুমাইয়াহ,
হযরত
লুবাইনাহ,
হযরত
নাহদিয়াহ
ও
হযরত
উম্মে
“উবাইস
(রাদিয়াল্লাহু
তা'আলা
'আনহুন্না)।
কাফিররা হযরত
মুহাম্মাদ
(সাঃ)-কে
ঠাট্টাবিদ্রুপ
ও
অপদস্ত
করে।
তারা তাঁকে যাদুকর বলে অভিহিত করে
এবং তিনি যাদুগ্রস্ত বা
জিনগ্রস্ত বলেও তাঁর বিরুদ্ধে
প্রচার চালানো হয়। একবার তিনি
নামাজ আদায় করার সময় একজন
কাফির তাঁকে শ্বাসরোধ করে
হত্যা
করার
চেষ্টা করে। এসময় হযরত আবু
বকর
(রাঃ)
এসে পড়েন এবং তাঁকে উদ্ধার
করেন।
উম্মে জামিলার
ঘটনা
এছাড়া আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ঘরের সামনে থেকে শুরু করে তাঁর নিয়মিত চলাচলের পথে কাঁটা ও ময়লা- আবর্জনা ছড়িয়ে রাখত। কিন্তু হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) জবাবে কিছুই বলতেন না, বরং নীরবে এ সব সরিয়ে দিয়ে পথ চলতেন।
হঠাৎ একদিন তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে, তাঁর ঘরের সামনের পথ পরিষ্কার- কোন কাঁটা বা ময়লা-আবর্জনা নেই। তিনি বুঝতে পারলেন যে, উম্মে জামীল হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই তিনি তাকে দেখার জন্য গেলেন। এ থেকেই প্রমাণ হয় তিনি কত বড় মহান ছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সব সময়ই সকলের প্রতিই, এমন কি তাঁর শত্রুদের প্রতিও দয়া ও মহানুভবতা দেখাতেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) (hazrat muhammad saw) আরো বেশী আশাবাদ ও দৃঢ়তা সহকারে ইসলামের প্রচার অব্যাহত রাখেন। সাথে সাথে কাফিরদের দুশমনীও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্য কাফিররা তাদের সাধ্যমত সকল চেষ্টাই করতে লাগল।
কিন্তু তাদের সে চেষ্টায় কোনই
ফল হয়নি। বরং কাফিরদের পক্ষ
থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)
ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যাপ্রচার, জুলুম-নির্যাতন ও অপমান-লাঞ্ছনা
সত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলন অব্যাহত থাকে এবং মক্কাবাসীদের
মধ্যে দিনের পর দিন অনেক
বেশী সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ
করতে থাকে।
এসময়
হযরত রাসূলূল্লাহ (সাঃ)-এর ছোট
চাচা হযরত
হামযাহ
(রাঃ)
ইসলাম
গ্রহণ
করেন। হযরত হামযাহ (রাঃ)
একজন সাহসী লোক ছিলেন। একারণে,
তিনি ইসলাম গ্রহণ করায় ইসলামের শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়।
তিনি ইসলাম গ্রহণ করায় কাফির কুরাইশরা মুসলমানদের অপদস্ত করা থেকে অনেকাংশে
বিরত থাকতে বাধ্য হয়।
আবু জেহেল এর জীবনী সংক্ষিপ্ত
আবু জেহেল
ও
উটবিক্রেতা
একদিন হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কা'বাহ ঘরের কাছাকাছি এক জায়গায় বসা ছিলেন। ঐ সময় কা'বাহ ঘরের পাশে কুরাইশ গোত্রের লোকদের এক বৈঠক চলছিল। তখন ইরাশ থেকে আগত এক ব্যক্তি সেখানে এল এবং লোকদের নিকট সাহায্য চাইল।
সে বলল: “আপনাদের
মধ্যে এমন কে আছেন
যিনি আবুল হাকাম বিন
হিশামের নিকট থেকে পাওনা
আদায়ের ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবেন? আমি একজন বহিরাগত
ব্যক্তি, একজন পথিক। কিন্তু
তিনি আমার পাওনা পরিশোধ
করছেন না।”
আবু জাহেল
কি
নবীর
চাচা
ছিল
আবুল হাকাম
বিন
হিশাম
ছিল মক্কার প্রভাবশালী লোকদের একজন। তিনি মহানবী সাঃ এর চাচা ছিলেন না। সে
মুসলমানদের খুবই ঘৃণা করত
এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে দুশমনী ও ব্যাপক সহিংস
আচরণ করত। 'আবুল হাকাম' মানে
'জ্ঞানপিতা'
অর্থাৎ ‘অত্যন্ত জ্ঞানবান ব্যক্তি'। কিন্তু সে
ইসলামের বিরুদ্ধে অন্ধবিদ্বেষ ও অন্ধশত্রুতা পোষণ
করত বিধায় ‘আবু জেহেল' অর্থাৎ
মূর্খতার
পিতা'
বা ‘অত্যন্ত মুর্খতার অধিকারী' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
কুরাইশদের
ঐ সমাবেশে যারা হাযির ছিল
তাদের বেশীর ভাগই ছিল আবু
জেহেলের বন্ধু। তাই
তারা আগন্তুক ব্যক্তির কথা শুনলেও এ
ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে
কেউ আবু জেহেলের বিরাগভাজন হতে চাচ্ছিল না।
বরং তারা মনে করল
যে, এ ঘটনাটাকে কাজে
লাগিয়ে হযরত
মুহাম্মাদ
(সাঃ)-এর প্রতি আবু
জেহেলের দুশমনী বৃদ্ধি করবে। তাই তারা হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) কে দেখিয়ে
বলল: “তুমি ঐখানে একজন
লোককে বসা দেখতে পাচ্ছ?
তার কাছে যাও; সে
তোমাকে সাহায্য করবে।”
আবু জেহেল
লোকটি
জানত না যে, আবু
জেহেল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ঘোরতর দুশমন।
তাই সে তাঁর কাছে
গিয়ে তার সমস্যার কথা
বলল। সে জানাল যে,
সে আবু জেহেলের নিকট
উট বিক্রি করেছে, কিন্তু বার বার তাগাদা
করা সত্ত্বেও সে এখনো তার
পাওনা পরিশোধ করেনি।
তখন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কোনরূপ দ্বিধা না করেই লোকটিকে সাহায্য করতে রাযী হলেন। তিনি লোকটির সাথে আবু জেহেলের বাড়ীতে গেলেন। দূর থেকে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা ঘটনাটি দেখতে লাগল এবং দু'জনের মধ্যে একটা বড় ধরনের সংঘাত বাধার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল।
তাছাড়া তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পিছনে পিছনে পাঠাল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আবু জেহেলের ঘরের দরজায় শব্দ করলেন। আবু জেহেল ভিতর থেকে আওয়ায দিল: “কে?” হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বললেন, “আমি মুহাম্মাদ। বেরিয়ে এসো।” আবু জেহেল উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে এল। কিন্তু বেরোবার পর তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) দৃঢ় কণ্ঠে
বললেন: “এই লোকটির পাওনা
দিয়ে দাও। ”আবু জেহেল বলল
: “এক মিনিট অপেক্ষা কর; আমি এক্ষুনি
তার পাওনা নিয়ে আসছি।" সে ঘরের মধ্যে
চলে গেল এবং খুব
তাড়াতাড়ি টাকাসহ বেরিয়ে এসে লোকটির পাওনা
পরিশোধ করে দিল। হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) আগন্তুক লোকটিকে
বললেন: “তুমি এবার তোমার
নিজের কাজে যেতে পার।”
লোকটি
খুবই আনন্দিত হল। সে কুরাইশদের
সমাবেশের কাছে গিয়ে বলল:
“আল্লাহ্ তাঁকে পুরস্কৃত করুন; তিনি আমার পাওনা
আদায় করে দিয়েছেন।” এরপর
লোকটি আনন্দের সাথে নিজের পথে
চলে গেল।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও আবু জেহেলের মধ্যে সংঘাত বাধবে মনে করে তা চাক্ষুষভাবে দেখার জন্যে যে লোকটিকে পাঠানো হয়েছিল, এরপর সে ফিরে এল। সে বলল: “খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার! মুহাম্মাদ যখন আবুল হাকামের (অর্থাৎ আবু জেহেলের) ঘরের দরজায় আঘাত করল সাথে সাথেই আবুল হাকাম উত্তেজিত অবস্থায় বেরিয়ে এল।”
এরপর সে
যা দেখেছিল তা পুরোপুরি বর্ণনা
করল। এরপর আবু জেহেল স্বয়ং
সেখানে এসে হাযির হল।
সাথে সাথে তারা জিজ্ঞেস
করল: “ব্যাপার কি? আমরা তো
কক্ষনোই এমন কাণ্ড দেখিনি।
তুমি এটা কি করলে?”
আবু জেহেল
এর
জীবনী
আবু জেহেল রাগের ও বিস্ময়ের সাথে বলল: “গোল্লায় যাও তোমরা। আল্লাহর কসম, সে যখন আমার দরজায় আঘাত করল এবং তার গলার আওয়ায শোনার সাথে সাথেই কেন জানি আমার মধ্যে আতঙ্ক এসে গেল।
এরপর আমি যখন বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালাম তখন আমার মনে হচ্ছিল যে, তার মাথার ওপর দিয়ে একটি বিরাটাকারের উট গলা বাড়িয়ে আছে এবং উটটির কাঁধ ও দাঁতগুলো এমনই যে, আমি এর আগে এমনটি আর দেখিনি। আল্লাহর কসম, আমি যদি লোকটির পাওনা পরিশোধ করতে অস্বীকার করতাম তাহলে নিঃসন্দেহে উটটি আমাকে খেয়ে ফেলত।"
কেমন বিস্ময়কর সাহসের
অধিকারী ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)!
আর কতই না মজবুত
চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি! তিনি সব সময়ই
ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতেন
এবং যাদের সাহায্যের প্রয়োজন হত তাদেরকে সাহায্য
করতেন। এজন্য এমন কি তিনি
তাঁর জঘন্যতম দুশমনের মুখোমুখি হতেও দ্বিধা করতেন
না।
বস্তুতঃ আবু জেহেল উদ্ধত ও অহঙ্কারী ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি ঘোরতর ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করা সত্ত্বেও তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সামনে তার পক্ষে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। এর কারণ ছিল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)- এর প্রতি আল্লাহ্ তা'আলার গায়েবী সাহায্য।
এ ঘটনার মধ্যে আমাদের জন্যে একটি মূল্যবান শিক্ষা রয়েছে। তা হচ্ছে, আমাদেরকে আল্লাহ্ তা'আলার হুকুম মেনে চলতে হবে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে। আমাদেরকে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে এবং দুর্বল, নির্যাতিত ও অসহায়দের পক্ষে কথা বলতে হবে।
জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ অর্থাৎ আমাদের সকল শক্তি ও উপায় উপকরণ ব্যবহার করে ইসলামের জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের শুধু হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনী পড়লেই হবে না, আমাদেরকে তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণের চেষ্টা করতে হবে।
উতবাহ ইবনে রাবি'আহ এর
প্রস্তাব
কুরাইশ গোত্রের অন্যতম নেতা ‘উৎবাহ বিন রাবী'আহ হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর সামনে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করে। সে বলল “তুমি যদি অর্থকড়ি চাও তাহলে আমরা আমাদের ধনসম্পদ একত্র করে তোমাকে দেব, তখন তুমি হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।
তুমি
যদি সম্মান চাও, তাহলে আমরা
তোমাকে আমাদের গোত্রপতি বানাব, তখন তুমি নিজে
যে কোন বিষয়ে যে
কোন সিন্ধান্ত নিতে পারবে। আর
তুমি যদি রাজা হতে
চাও তাহলে আমরা তোমাকে রাজা
বানাব।'
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) জবাবে কুর'আন মজীদের সূরাহ হা-মীম-আস্- সাজদাহ (সূরাহ নং-৪১)-এর কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করেন এবং তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন উৎবাহ তার সঙ্গী সাথীদের নিকট ফিরে আসে। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।
সে
এসে তাদেরকে জানাল যে, সে হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট
থেকে এমন কিছু কথা
শুনেছে যেরূপ কথা এর আগে
কখনো কারো কাছ থেকে
শোনেনি। বস্তুতঃ কোন পার্থিব লোভ-লালসাই হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ)
কে সত্যের প্রচার থেকে ফিরিয়ে রাখতে
পারেনি।
কুরাইশ বংশের ইতিহাস
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও মুসলমানদেরকে ইসলামে ঈমান পোষণ ও এর প্রচার থেকে বিরত রাখার জন্যে কুরাইশদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। অপমান ও লাঞ্ছণা-গঞ্জনা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, জুলুম-নির্যাতন ও মিথ্যা প্রচারণা ব্যর্থ প্রমাণিত হল, বরং মুসলমানরা আরো বেশী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন।
কুরাইশ বংশের নেতারা এবার আরো ধূর্ততাপূর্ণ
ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিল। তারা হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট
প্রস্তাব দিল যে, তিনি
যদি তাদের দেবদেবীদের পূজা
করেন তাহলে প্রতিদানে তারাও হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-
এর ইলাহ আল্লাহর ইবাদাত
করবে। তাহলে দু'পক্ষের মধ্যে
একটা আপোষরফা হবে ও শত্রুতা
দূর হবে।
তখন আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিকট দিক নির্দেশনা নাযিল হয়। আল্লাহ্ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণার নির্দেশ দেন যে, মৌলিক নীতিমালার প্রশ্নে এ ধরনের কোন আপোষরফা হতে পারে না। তাঁকে ঘোষণা করতে বলা হয়: “আমাদের রয়েছে আমাদের নিজস্ব জীবনব্যবস্থা, আর আমারও রয়েছে নিজস্ব জীবনব্যবস্থা।” (সূরাহ আল-কাফিরূন-৬) এভাবে সত্য ও মিথ্যাকে মিশ্রিত করার পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেল। এগুলো হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়।