হযরত ওমর ফারুক রাঃ এর জীবনী
হযরত ওমর ফারুক রাঃ এর জীবনী
হযরত ওমর রাঃ এর জীবনী: প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ) ইন্তেকালের পূর্বে শীর্ষস্থানীয় ছাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে হযরত ওমর (রাঃ) কে মুসলিম উম্মাহ্ দ্বিতীয় খলীফা মনোনীত করে যান৷
হযরত
‘ওমর (রাঃ) র পিতার
নাম ছিল আল-খাত্তাব।
ইসলামের ইতিহাসে তিনি 'আল- ফারূক' নামে
পরিচিত। ‘আল-ফারূক' মানে
‘পার্থক্যকারী’; তাঁকে 'সত্য ও মিথ্যার
মধ্যে পার্থক্যকারী' অর্থে এ খেতাব দেয়া
হয়। তাঁর ইসলাম গ্রহণের
ঘটনা ইতিপূর্বে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনেতিহাসে উল্লেখ
করা হয়েছে।
হযরত
'ওমর (রাঃ) ছিলেন খুবই
সাহসী ও স্পষ্টভাষী লোক।
মৌলিক নীতিগত বিষয়সমূহে তিনি ছিলেন খুবই
কঠোর ও আপোষহীন। তিনি
ছিলেন একজন মহান ও
কর্মদক্ষ শাসক। তাঁর খিলাফত কালে
ইসলামী হুকুমাতের আয়তন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
হযরত 'ওমর (রাঃ) নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুবই দৃঢ় ছিলেন। তাঁর সময় মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন হযরত খালিদ বিন আল-ওয়ালীদ (রাঃ)। তিনি খালিদের ব্যাপক জন-প্রিয়তার বিষয়টি লক্ষ্য করেন এবং আশঙ্কা করেন যে, তাঁর সম্পর্কে লোকদের উঁচু ধারণা সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে।
তাই তিনি হযরত খালিদ বিন আল-ওয়ালীদ (রাঃ) কে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক
পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে হযরত আবু “উবাইদাহ বিন আল-জাররাহ (রাঃ) কে এ পদে নিয়োগ করেন।
হযরত
ওমর (রাঃ)-এর এ পদক্ষেপের পিছনে আরেকটি কারণ ছিল এই যে, তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন, প্রকৃত
পক্ষে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য কোন ব্যক্তিবিশেষ অপরিহার্য নন, বরং আল্লাহ্ তা'আলার সাহায্যই
অপরিহার্য।
'আল্লামাহ্
শিবলী নু'মানী (রঃ)-এর মতে, হিজরী ১৭ সালে সিরিয়া (আশ্-শাম) বিজয়ের পরে হযরত খালিদ
বিন আল-ওয়ালীদ (রাঃ) কে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য কতক ঐতিহাসিকের
মতে, হযরত ‘ওমর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব লাভের পর এটা ছিল তাঁর দেয়া প্রথম আদেশ।
হযরত খালিদ বিন আল-ওয়ালীদ (রাঃ) বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্যে খুবই বিখ্যাত ছিলেন এবং এ জন্যে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁকে সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তলোয়ার) খেতাব দিয়েছিলেন। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে খলীফার আদেশ মেনে নেন। তিনি হযরত আবু ‘উবাইদাহ (রাঃ)-এর অধীনে
একজন
সাধারণ সৈন্য হিসাবে থেকে যান। বস্তুতঃ এ হচ্ছে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য সংক্রান্ত
ইসলামী শিক্ষার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নির্দেশে হযরত খালিদ বিন আল ওয়ালিদ (রাঃ) ইরাকী রণাঙ্গণের সেনাপতি হযরত আল-মুছান্না (রাঃ)-এর নিকট অর্পণ করে ইয়ারমুক রণাঙ্গণে চলে যান।
হযরত
আল-মুছান্না (রাঃ) পারস্য বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করা খুবই কঠিন দেখতে পেলেন এবং খলীফা
হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর নিকট আরো সৈন্য চাওয়ার জন্যে নিজেই মদীনাহ চলে গেলেন। এ সময়
হযরত আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুশয্যায় ছিলেন।
এদিকে হযরত আল-মুছান্না (রাঃ) ইরাকে অনুপস্থিত থাকায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পারস্য সৈন্যরা সেনাপতি রোস্তমের অধীনে পুনারায় সংঘবদ্ধ হয়। ইতিপূর্বে মুসলমানরা তাদের কাছে থেকে যে সব এলাকা দখল করে নিয়েছিল তারা পুনরায় তা দখল করে নেয়।
এছাড়া রোস্তম হিরাহ্
ও কাসকারে দুই দল সৈন্য পাঠান। হযরত ওমর (রাঃ) পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে হযরত আবু
‘উবাইদ আছ-ছাকাফী (রাঃ) কে পাঠান এবং তিনি পারস্যের উভয় সৈন্যদলকে পরাজিত করেন।
এ খবর জানার পর পারস্য বাহিনীর প্রধান সেনাপতি রোস্তম তার অধীনস্ত অপর এক সেনাপতি বার্মানের অধীনে হাতীসহ এক বিরাট সেনাবাহিনী পাঠান। দুই পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং আল-জি বা পুল (Bridge)-এর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়।
খলীফা হযরত ‘ওমর (রাঃ) আরেকটি সেনাবাহিনী
পাঠালেন এবং হযরত আল-মুছান্না (রাঃ) পরাজিত সৈন্যদেরকে পুনরায় সংঘবদ্ধ করলেন। তাঁরা
বীরবিক্রমে যুদ্ধ করলেন। এবার পারস্য বাহিনী পরাজিত হল।
হযরত ওমর রাঃ এর ঘটনা
এরপর পারস্য সম্রাট আরো একটি বড় সেনাবাহিনী পাঠান। ফলে হযরত আল-মুছান্না (রাঃ) পিছু হটে আসতে বাধ্য হন। এ নতুন পরিস্থিতির খবর হযরত 'ওমর (রা) কে জানানো হল। তখন তিনি হযরত সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর অধীন আরো সৈন্য পাঠালেন পারস্য বাহিনী ও মুসলিম বাহিনী কাদিসিয়াহ নামক স্থানে পরস্পর মোকাবিলা করে।
কয়েকটি রণাঙ্গণে দীর্ঘ যুদ্ধের পর অল্প
সংখক সৈন্যের মুসলিম বাহিনী এক লাখ বিশ হাজার সৈন্যের বিশাল পারস্য বাহিনীকে পরাজিত
করে। মুসলমানরা হিরাহ্ ও অন্যান্য এলাকা পুনরায় দখল করেন। এটা হিজরী চতুর্দশ সালের
(৬৩৬ খৃস্টাব্দের) ঘটনা।
অন্যদিকে
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর সময়ই মুসলিম বাহিনী দামেস্ক অবরোধ করেছিল। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর
ইন্তেকাল ও হযরত 'ওমর (রাঃ)-এর খলীফা হবার পরে আরো ৭০ দিন অবরোধ চলে। হযরত খালিদ বিন
আল-ওয়ালিদ (রাঃ) আকস্মিক হামলা চালিয়ে দামেস্কে প্রবেশ করেন। তখন শহরের রোমান প্রশাসক
আত্মসমর্পণ করেন ও দু'পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ইতিমধ্যে
হযরত ‘আমর বিন আল-'আস (রাঃ) বায়তুল মুকাদ্দিস (জেরুসালেম) অবরোধ করে রাখেন। পরে হযরত
খালিদ বিন আল-ওয়ালীদ (রাঃ) ও হযরত আবু ‘উবাইদাহ বিন আল-জাররাহ (রাঃ) ও অন্য কয়েকজন
সেনাপতি তাঁর সাথে যোগ দেন।
বায়তুল
মুকাদ্দিস খৃস্টান অধিবাসীদের পক্ষে মুসলমানদের মোকাবিলায় জয়লাভের কোনই সম্ভাবনা
ছিল না। তাই তারা মুসলমানদের হাতে শহর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তারা মুসলমানদের
নিকট এই বলে প্রস্তাব দেয় যে, খলীফা হযরত ‘ওমর (রাঃ) নিজে বায়তুল মুকাদ্দিস এলে তারা
শহরটি তাঁর নিকট হস্তান্তর করবে।
খৃস্টানদের এ প্রস্তাবের কথা মদীনায় খলীফা হযরত 'ওমর (রাঃ) কে জানানো হল। তিনি এ প্রস্তাবে রাযী হলেন এবং একজন সাথীসহ একটি উটে চড়ে বায়তুল মুকাদ্দিস পথে রওয়ানা হলেন। তাঁরা পালাক্রমে উঠে সওয়ার হতেন। কিছু সময় খলীফা উটের রশি ধরে হেঁটে চলতেন এবং তাঁর সাথী উটের পিঠে বসে থাকত, কিছু সময় সাথী উটের রশি ধরে হেঁটে চলত এবং খলীফা উটের পিঠে বসে থাকতেন।
বস্তুতঃ এটাই হচ্ছে ইসলামী ন্যায়নীতি। শাসক ও শাসিতের অধিকার সমান। ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের
শাসকদের অবশ্যই তাঁদের নিজেদের অধিকারের ওপর নাগরিকদের অধিকার স্বীকার করা উচিত।
ইসলামী হুকুমাতের খলীফা সাধারণ পোশাকে বায়তুল মুকাদ্দিস প্রবেশ করেন। ফলে খৃস্টানদের পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন ছিল যে, মুসলিম জাহানের নেতা সেখানে এসেছেন। এমনই সাদাসিধেভাবে চলতেন হযরত ‘ওমর (রাঃ)। তিনি সব সময়ই অত্যন্ত সাধারণ মানুষের মত সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন।
কিন্তু শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই কড়া ও তাঁর যুগের সব চেয়ে সুদক্ষ শাসক। তাঁর
কোন অহঙ্কার ছিল না। তিনি কোনরূপ জাঁকজমক ও চাকচিক্য পছন্দ করতেন না। আর এটাই হচ্ছে
ইসলামের শিক্ষা। আজকের দিনের মুসলিম শাসকরা এ শিক্ষা ভুলে গেছেন; আমাদেরকে অবশ্যই এ
শিক্ষার পুনরুজ্জীবন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
যা-ই
হোক, হযরত ‘ওমর (রাঃ) বায়তুল মুকাদ্দিস প্রবেশের পর শহরের খৃস্টান অধিবাসীদের নিরাপত্তার
নিয়শ্চয়তা দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ভিত্তিতে খৃস্টানরা শহরটি মুসলমানদের
নিকট হস্তান্তর করে।
হযরত
'ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যদ্বয়ের বিশাল এলাকা এবং সমগ্র মিসর
ইসলামী শাসনের আওতায় আসে।
হযরত
ওমর (রাঃ) একজন সুবক্তা ছিলেন। তিনি তাঁর শাসনাধীন নাগরিকদের কল্যাণের জন্যে খুবই উদ্বিগ্ন
থাকতেন। তিনি তাঁর পরবর্তী যুগের মুসলমানদের জন্যে অমূল্য শিক্ষা রেখে যান।
হযরত ওমর রাঃ এর মৃত্যুর
ঘটনা
দ্বিতীয় খলীফা হযরত ‘ওমর (রাঃ) ফিরূয নামে একজন অমুসলিম ইরানীর আঘাতে আহত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ফিরূযের ডাকনাম ছিল আবু লুলু'। ফিরূয তার মনিব আল-মুগীরাহ বিন শু'বাহ-এর বিরুদ্ধে হযরত উমারের (রাঃ) নিকট নালিশ করেছিল।
মুগীরাহ বিন শু'বাহ্ তার ওপর কর ধার্য করেছিলেন। হযরত
ওমর (রাঃ) সব কিছু বিস্তারিত শোনার পর ফিরূযকে বলেন যে, এ কর ন্যায়সঙ্গতভাবেই ধার্য
করা হয়েছে। এতে ফিরূয ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং পরদিন ফজরের ছালাতের সময় সে একটি ছুরি দ্বারা হযরত ওমর (রাঃ) কে ছয়বার
আঘাত করে। এতে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং তিনদিন পর ইন্তেকাল করেন। এটা হিজরী ২৩ সালের
(৬৪৪ খৃস্টাব্দের) ঘটনা।
হযরত 'ওমর (রাঃ) ইন্তেকালের আগে পরবর্তী খালীফা নির্বাচনের জন্যে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন এবং তাঁদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন খলীফা নির্বাচনের জন্যে পরামর্শ দিয়ে যান।
এই কমিটির সদস্যগণ ছিলেন: হযরত উছমান বিন ‘আফফান, হযরত 'আবদুর রহমান বিন ‘আউফ,
হযরত ‘আলী বিন আবি তালিব, হযরত আয্-যুবায়র বিন আল-'আউয়াম, হযরত সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস
ও হযরত তালহাহ বিন উবায়দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম)।
হযরত
ওমর আল ফারূক দশ বছর ছয় মাস চারদিন ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন।
হযরত ওমর (রাঃ)-এর উপদেশ
- **কারো খ্যাতির দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ো না।
- **কোন লোককে কেবল তার ছালাত আদায় ও ছাওম পালনের দ্বারা বিচার করো না, বরং তার সত্যবাদিতা ও প্রজ্ঞার দিকে নযর দাও।
- **যে ব্যক্তি গোপনীয়তা রক্ষা করে সে তার কাজকর্ম ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
- **তুমি যে ব্যক্তিকে ঘৃণা কর তাকে ভয় করে চলো।
- **সে-ই জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান যে নিজের কাজকর্মের মূল্যায়ন করতে পারে। তোমার কাজকে আগামীকালের জন্য ফেলে রেখো না।
- **যার গুনাহ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই সে সহজেই গুনাহর ফাঁদে আটকা পড়তে পারে কোন ব্যক্তির প্রশ্নের দ্বারা তার জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা কর।
- **বস্তুগত কল্যাণের ব্যাপারে কম উদ্বেগ ব্যক্তিকে স্বাধীন জীবন যাপনে সক্ষম করে তোলে।
- **তাওবাহ করার চেয়ে গুনাহ না করা সহজতর।
- **কানা'আত্ (অল্পে তুষ্টি) ও শোকর (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ) দু'টি বিরাট সদগুণ; এর মধ্যে তুমি কোন্টি লাভ করছ তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।
- **যে তোমার দোষত্রুটি দেখিয়ে দেয় তার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
পোস্ট ট্যাগঃ