হিজরতের ঘটনা
হিজরতের ঘটনা
নবীজির হিজরতের কাহিনী-আল্-‘আকাবা নামক স্থানে হিজরি (hijri calendar) ৬২২ খৃস্টাব্দে মদীনার মুসলমানরা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে দ্বিতীয় বার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হন। এতে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা অংশগ্রহণ করেন।
কার্যতঃ এটি ছিল আল-'আকাবাহর প্রথম অঙ্গীকারের নবায়ন ও সম্প্রসারণ। মদীনার মুসলমানরা অঙ্গীকার করেন যে, তাঁরা তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের যেভাবে রক্ষা করবেন ঠিক সেভাবেই তাঁরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে সাহায্য ও রক্ষা করবেন।
এ অঙ্গীকারের পরিণতিতে যেসব বিপদজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর চাচা হযরত 'আব্বাস (রাঃ) তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। তা সত্ত্বেও মদীনার মুসলমানরা বললেন: “জীবন ও ধন-সম্পদের ওপর যে কোন ধরনের হুমকি আসার সম্ভাবনা জেনেও আমরা তাঁকে (রাসূলকে) গ্রহণ করেছি।
হে রাসূলুল্লাহ! আমাদেরকে বলুন, আমরা আমাদের অঙ্গীকার পূরণ
করলে বিনিময়ে কি পুরষ্কার পাব?” হযরত রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) (Hazrat Rasulullah SAW) বললেন: “জান্নাত”।
তাঁরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তিনিও তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এভাবে মদীনার মুসলমানরা মক্কাবাসীদের হামলা থেকে তাঁকে হেফাযত করাকে নিজেদের জন্যে কর্তব্যে পরিণত করে নিলেন। তাঁরা তাঁর ডাকে সাড়া দেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাঁরা
সংখ্যায় ছিলো ছয়জন। তাঁরা ঈমানদার হিসেবে মদীনায় ফিরে যান এবং তাঁদের গোত্রের অন্যান্য
লোকদেরকেও ইসলাম গ্রহণের জন্যে দাওয়াত দেন।
পরের বছর হজের সময় মদীনা থেকে বারজন লোকের একটি দল মক্কায় আসেন। তাঁরা আল্-‘আকাবাহ নামক স্থানে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করেন এবং একটি অঙ্গীকার করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ অঙ্গীকার আল্-‘আকাবাহর প্রথম অঙ্গীকার নামে পরিচিত। তাঁরা এ মর্মে অঙ্গীকার করেন যে, তাঁরা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো আনুগত্য করবেন না,
চুরি করবেন না, ব্যাভিচার করবেন না, শিশুহত্যা করবেন না, কোন পাপ কাজ করবেন
না এবং আল্লাহকে অমান্য করবেন না। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁদেরকে বলেন যে, তাঁরা যদি
এ অঙ্গীকার পালন করেন তাহলে আল্লাহ্ তাঁদের ওপর সন্তুষ্টু হবেন এবং আখিরাতে তাঁদেরকে
পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত প্রদান করবেন।
মদীনায় হিজরতের ঘটনা
আল্-‘আকাবার দ্বিতীয় অঙ্গীকার ছিল ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিমূহূর্ত। কারণ এসময় থেকে মুসলমানদের জন্য আশ্রয় নেয়ার মত একটি জায়গা হল। যুদ্ধ ও বিপদাপদের সময় সাহায্যের জন্য তাঁরা একটি মিত্রপক্ষ পেলেন। আল্-‘আকাবার দ্বিতীয় অঙ্গীকার অনুষ্ঠিত হবার পর ঘটনাক্রমে কাফিররা তা জানতে পারে।
অত্যন্ত গোপনে এ অঙ্গীকার অনুষ্ঠিত হয়।
ফলে কাফিরদের পক্ষে তা নস্যাত করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু পরে যখন তারা তা জানতে পারে
তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মদীনার কিছু লোকের ওপর নির্যাতন চালায়।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর
হিজরতের ঘটনা
এবার
তাঁর কাজের কৌশল পরিবর্তন করলেন। দীর্ঘ তের বছর যাবত তিনি মক্কার লোকদের মধ্যে আল্লাহর
বাণী প্রচারের চেষ্টা করেন। কিন্তু এজন্য মক্কাহ যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল না। অন্যদিকে মদীনা (Madina) তাঁর সামনে দ্বীন প্রচারের
জন্যে একটি উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে উপস্থিত হয় যা ইসলাম গ্রহণের জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত।
তাই তিনি এ সুযোগ গ্রহণ করার ও সেখানে ইসলামের বীজ বপনের সিদ্ধান্ত নেন।
মুহাজির কারা এবং আনসার কাকে বলে?
হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মক্কার মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরত শুরু করার এবং সেখানকার মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক মযবূত করার জন্যে নির্দেশ দিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছ থেকে নির্দেশ পাবার পর মক্কার মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে ও ছোট ছোট দলে মদীনায় হিজরত শুরু করেন।
মুহাজির
ও আনসার কারা পরবর্তীকালে মক্কাহ থেকে আগত মুসলমানরা ইসলামী ইতিহাসে 'মুহাজির' নামে এবং তাঁদেরকে আশ্রয়দানকারী
মদীনার মুসলমানরা 'আনছার' (ansar) নামে পরিচিত হন।
মক্কার কাফিররা মুসলমানদের মদীনায় হিজরত বন্ধ করাবার জন্যে চেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। একারণে তারা আরো বেশী ক্ষিপ্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠে হিজরতের বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তা করে দেখুন। মক্কার মুসলমানরা আল্লাহ হুকুমে এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে তাঁদের বাড়ীঘর ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান। বস্তুতঃ তখন তাঁদের জন্যে এটাই করণীয় ছিল।
মুসলমান হিসেবে আমাদেরকেও ঈমানের খাতিরে
প্রয়োজনে হলে এরূপ কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা যদি এ ধরনের মনোভাব ও চেতনার
অধিকারী হতে পারি কেবল তখনই এ পৃথিবীর জীবন অর্থবহ হয়ে উঠবে। কেবল তখনই আমাদের পক্ষে
আল্লাহ্ তা'আলার প্রকৃত বান্দাহ্ হিসেবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে।
হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর
হিজরত
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ছাহাবীদের (সঙ্গীসাথীদের) বেশীর ভাগই মদীনায় হিজরত করলেন। তিনি
নিজে হিজরত করার জন্যে আল্লাহ্ তা'আলার নিকট থেকে অনুমতির অপেক্ষা করছিলেন।
ইসলামিক উক্তি
তাঁর
ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হযরত আবু বকর (রাঃ) ও মদীনায় হিজরত করতে চাচ্ছিলেন এবং এজন্য হযরত
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট অনুমতি চাইলেন। জবাবে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন (ইসলামিক উক্তি) “এজন্য তাড়াহুড়ো করবেন না;
হয়ত আল্লাহ্ আপনার জন্যে কোন সাথী নির্ধারণ করে দেবেন।”
হযরত
আবু বকর (রাঃ) আশা করতে লাগলেন যে, হয়ত হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজেই তাঁর সাথী হবেন।
এরপর আল্লাহ্ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে হিজরতের অনুমতি দিলেন এবং হযরত আবু বকর
(রাঃ) তাঁর সাথী মনোনীত হলেন। হযরত আবু বকর
(রাঃ) এতে খুবই খুশী হলেন। তিনি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করলেন।
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের আগেই মক্কার কাফিররা তাঁকে হত্যার জন্যে ষড়যন্ত্র
করে। ঠিক এ সময়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে হিজরতের অনুমতি দেয়া হয়। তিনি রাতের বেলা
গোপনে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে সাথে নিয়ে মদীনার উদ্দেশে মক্কাহ ত্যাগ করেন। এটা ছিল
হিজরি ৬২২ খৃস্টাব্দের ঘটনা।
এদিকে
কাফিররা ঐ দিনই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। তারা এজন্য
একটি বিশেষ ঘাতকদল তৈরী করে। ঘাতকদল ঐদিন
রাতেই হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বাড়ী ঘেরাও করে রাখে এবং তিনি ঘর থেকে বের হলে সাথে
সাথে তাঁকে হত্যা করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
এদিকে
হযরত ‘আলী (রাঃ) (Ali R.A) তখন হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ)-এর ঘরে ছিলেন এবং তাঁর বিছানায় ঘুমিয়ে থাকেন। আর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নীরবে
তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে যান, কিন্তু তাঁর ঘর ঘিরে রাখা সত্ত্বেও কাফিররা তাঁকে দেখতে
পায়নি। এটা ছিল আল্লাহ্ (Allah) তা'আলারই
পরিকল্পনা। আর আল্লাহ্ যখন কোন কিছু করতে চান তখন তিনি শুধু বলেন: (ইসলামিক উক্তি) “হও।”
আর “অমনি তা হয়ে যায়।” (সূরাহ ইয়াসীন-৮২)
সকাল
বেলা কাফিররা হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পরিবর্তে হযরত 'আলী (রাঃ) কে তাঁর বিছানায় দেখতে পায়। এতে তারা হতভম্ব হয়ে যায়।
সাওর গুহা
হযরত
মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথী হযরত আবু বকর (রাঃ) সকাল হবার আগে মক্কাহ ত্যাগ করেন এবং
মক্কার দক্ষিণে অবস্থিত সাওর নামক গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁরা তিন দিন সেখানে
থাকেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) এর একজন
গোলাম প্রতি সন্ধ্যায় তাঁদেরকে খাবার পৌঁছে দিতেন। তাঁরা তৃতীয় দিনে সাওর গুহা থেকে বের হয়ে মদীনায় রওয়ানা
হয়ে যান।
কাফিররা
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে হত্যার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
গ্রহণ করা সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে বোকা বানিয়ে মক্কাহ ত্যাগ করায় তারা তাঁকে খুঁজে
বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মক্কাহ থেকে মদীনার পুরো পথে তাঁকে অনুসরণের ব্যবস্থা
করে এবং তাঁকে বন্দী করার জন্যে একশ উট
পুরষ্কার ঘোষণা করে।
ইসলামিক গল্প
যেসব কাফির হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সন্ধানে বের হয় তাদের মধ্যে একজন ছিল সুরাকাহ্ বিন মালিক। ইসলামিক গল্প (Islamic Story) সুরাকা দ্রুতগামী ঘোড়া ছুটিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছে এবং মনে হচ্ছিল যে, তাঁকে ধরে ফেলতে পারবে।
কিন্তু
তার ঘোড়া পর পর তিনবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। তাই সে একে অশুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করে
এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) কে বন্দী করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে। পরবর্তী সময়ে সুরাকাহ্
ইসলাম গ্রহণ করে।
ইসলামের প্রথম মসজিদ কোনটি? কুবা মসজিদ
অত্যন্ত ক্লান্তিকর ও কষ্টকর সফরের পর হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সাথী হযরত আবু বকর (রাঃ) সহ মদীনার নিকটে কুবা' (Quba Mosque) নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে তাঁরা দুই সপ্তাহ থাকেন। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সেখানে একটি মসজিদ তৈরী করেন।
এই কুবা মসজিদই
হচ্ছে ইসলামের প্রথম মসজিদ নামে পরিচিত।
ইতিমধ্যে হযরত ‘আলী (রাঃ) এসে তাঁদের সাথে
মিলিত হন।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এরপর মদীনায় এলেন। এখানে তিনি তাঁর উটকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিলেন যাতে তাঁকে নিয়ে যেখানে খুশী থামতে পারে। উটটি প্রথমে দুইজন ইয়াতীমের মালিকানাধীন একটি জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসে, তারপর উঠে গিয়ে হযরত আবু আইয়ুব আনছারী (রাঃ)-এর বাড়ীতে পৌঁছে পুনরায় হাঁটু গেড়ে বসে।
তখন
এ বাড়ীই মদীনায় হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রথম
থাকার জায়গা হিসেবে নির্ধারিত হল। মদীনার জনগণ অত্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সহকারে
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাই তারা তাঁকে নিজেদের মধ্যে
পেয়ে খুবই আবেগদীপ্ত ও আনন্দে উৎফুল্ল হল। তাঁকে তারা বীরোচিতভাবে অভ্যর্থনা জানাল।
হিজরি সনের ইতিহাসঃ (hijri calendar)
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরতের মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। এই ঐতিহাসিক হিজরতের দু'টি পরস্পরবিরোধী দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রিয় জন্মভূমি পরিত্যাগ করে আসার বেদনাদায়ক অনুভূতি, আরেকটি দিক হচ্ছে আগের চেয়ে বেশী স্বাধীনভাবে ইসলামের প্রচার প্রসারের আশাসহ নিরাপত্তার অনুভূতি।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মক্কা হতে মদীনায় হিজরতের বছর থেকে ইসলামী
সাল বা হিজরি সাল শুরু হয়। হযরত মুহাম্মাদ
(সাঃ)-এর নবুওয়াতে অভিষেকের পর ত্রয়োদশ বছরে অর্থাৎ ৬২২ খৃস্টাব্দে হিজরত সংঘটিত হয়। এ কারণে ঐ বছর থেকেই ইসলামী সাল বা হিজরি সাল গণনা করা হয়।
মক্কী জীবন সমাপ্তি
হিজরতের ফলে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর একটি নতুন ভূমিকা শুরু হয়। তা হচ্ছে রাষ্ট্রনায়ক ও শাসকের ভূমিকা। এসময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। হিজরতের মধ্য দিয়ে তাঁর মক্কী (Makka) জীবন সমাপ্ত হয় যার মধ্যে তের বছর ছিল নবুয়ত জীবন।
ইসলামিক পোস্ট (Islamic
Post)
ইসলামিক
পোস্ট গুলো নিয়মিত পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ইনশাআল্লাহ আরো বেশি বেশি ইসলামিক পোস্ট
পাবেন।