ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য
আমাদের
জীবনের বৃহত্তর উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা পৃথিবীর বুকে
আল্লাহর খলীফাহ। আমরা শুধু দেহের
অধিকারী নই, বরং রূহ
ও বিবেকের অধিকারী। বিবেক না থাকলে মানুষের
আচরণ পশুর চেয়েও অধম
হয় এবং সেক্ষেত্রে তারা
সমাজের জন্যে অসংখ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
ইসলামের
সব কিছুই মানুষের স্বার্থে ও মানুষের কল্যাণের
জন্যে। ইসলামের অর্থনৈতিক মূলনীতিসমূহের লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি ইনসাফ
ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা
যেখানে মানুষ দায়িত্বশীলতা ও সততার সাথে
আচরণ করবে। সেখানে কেউ সততা, ন্যায়পরায়ণতা,
সত্য, সৌজন্য, আস্থা ও দায়িত্বশীলতার প্রতি
উপেক্ষা প্রদর্শন করে যত বেশী
সম্ভব ধন- সম্পদ করায়ত্ত
করার জন্যে স্বার্থান্বেষীর ভূমিকা পালন করবে না।
ইসলামের
অর্থব্যবস্থা নিম্নলিখিত মূলনীতিসমূহের ওপর ভিত্তিশীল:
হালাল
উপার্জন ও ব্যয়
মুসলমানরা
খেয়ালখুশী মত যেকোন পন্থায়
আয় ও ব্যয় করতে
পারে না। আয়-ব্যয়
নিয়ন্ত্রণের জন্যে ইসলামের নিজস্ব আইন-কানুন রয়েছে।
এসব আইন-কানুন কুর'আন - সুন্নাহর ভিত্তিতে
রচিত হয়েছে। যেমন;
- ক. এ্যালকোহলযুক্ত পানীয় (মদ) উৎপাদন, বিক্রয় ও বিতরণ হারাম। জুয়া, লটারী, রিবা (সূদ)-এর লেনদেন থেকে উপার্জিত অর্থও হারাম। (সূরা আল-মায়িদাহ ৯০-৯১)
- খ. মিথ্যাচার, ধোঁকা-প্রতারণা, জালিয়াতি ও চুরির মাধ্যমে আয়-উপার্জন করা হারাম। বিশেষ করে প্রতারণামূলকভাবে ইয়াতীমদের সম্পদ আত্মসাৎ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। (সূরা আল-বাকারাহ-১৮৮)
- গ. মূল্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য অপরিহার্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মওজুদ করে রাখা (মজুদদারী করা), চোরাচালানী ও দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করা হারাম। (সূরা আলে ইমরান-১৮৩)
- ঘ. পতিতাবৃত্তি ও পতিতালয় পরিচালনা এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য অনৈতিক পন্থায় অর্থোপার্জনও হারাম। (সূরা আন্-নূর- ২৩)
ইসলাম সমস্ত রকমের পাপাচারের মূলে আঘাত করে এবং একটি ইনসাফ ভিত্তিক সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই একজন মুসুলমানকে অবশ্যই হালাল পন্থায় টাকা-পয়সা আয় করতে হবে। তাকে সব সময় মনে রাখতে হবে যে, সে যা কিছু করছে আল্লাহ্ তা'আলা তা জানেন।
তার সকল কাজকর্মের
জন্যে শেষবিচারের দিনে তাকে জবাবদিহি
করতে হবে। সর্বশক্তিমান ও
সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ তা'আলার নিকট
থেকে কোন কিছুই লুকানো
তার পক্ষে সম্ভব নয়।
ইসলামে
হারাম পন্থায় উপার্জনের যেমন অনুমতি নেই,
তেমনি হারাম কাজে টাকা-পয়সা
ব্যয় করারও অনুমতি নেই। একজন মুসলমান
দায়িত্বহীনভাবে তার টাকা-পয়সা
ব্যয় করতে পারে না।
বরং তাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে
ও ভেবেচিন্তে টাকা-পয়সা ব্যয়
করতে হবে। অমিত ব্যয়
ও অপচয়কে ইসলাম কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। (সূরা আল- আ'রাফ-৩১)
সম্পদের
অধিকার
ও
ব্যক্তিগত
স্বাধীনতা
ইসলামের
বিধান অনুযায়ী যে কোন ব্যক্তি
তার উপার্জিত টাকা পয়সা ও
ধনসম্পদের অধিকারী নিজেই। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা ও কাজ করার
বা উপার্জনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। তবে
শর্ত হচ্ছে এই যে, তার
স্বাধীনতার দ্বারা যেন সমাজের বৃহত্তর
কল্যান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রতিটি
ব্যক্তিই তার কাজকর্মের জন্য
শেষবিচারের দিনে আল্লাহ্ তা'আলার নিকট জবাবদিহি
করতে বাধ্য হবে। (সূরা আন্- নিসা'-
৭)
যাকাত
ব্যবস্থা/যাকাতের
গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক মূলনীতি হচ্ছে বাধ্যতামূলক যাকাত প্রদান। প্রত্যেক স্বচ্ছল মুসলমানের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রকে নির্ধারিত হারে যাকাত প্রদান ব্যাধ্যতামূলক (দ্বিতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। যাকাত ধনী ও গরীবদের মধ্যকার ব্যবধান কমাতে সহায়তা করে।
আসলে যাকাত
এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একটি আদর্শ ইসলামী
রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার (তথা
মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণের) নিশ্চয়তা বিধান করতে বাধ্য। ইসলামী
রাষ্ট্রে কারো কোনরূপ নিরাপত্তাহীনতা
ও ক্ষুধা-দারিদ্রের ভয় থাকার কথা
নয় (সূরা আত্-তাওবাহ-
৬৯)। যাকাতের মাধ্যমেই
এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হয় ৷
এছাড়া
ইসলাম ঐচ্ছিক দান (ছাদাকাহ) কে
খুবই উৎসাহিত করেছে। ছাদাকাহ সমাজের দরিদ্রতম ও সর্বাধিক দুর্বল
অংশকে সাহায্য করার আরেকটি পন্থা।
আল্লাহ্ তা'আলা যাদেরকে
তাদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ধনসম্পদ দিয়েছেন
তারা যাতে দরিদ্র ও
অস্বচ্ছল লোকদের প্রতি সহানুভুতি দেখায় এবং সামাজিক দায়িত্ব
পালন করে (সে উদ্দেশ্যে)
ছাদাকাহ দানে উৎসাহিত করা
হয়েছে।
রিবা
(সূদ)
হারাম
ইসলামী
অর্থনীতিতে রিবা (সূদ) সংক্রান্ত সকল
প্রকার লেনদেন হারাম করা হয়েছে। রিবাকে
অনেক ক্ষেত্রে 'মুনাফা' নামকরণ করা হয়। কিন্তু
রিবাকে ‘সূদ' বা 'মুনাফা'
যে নামেই নামকরণ করা হোক না
কেন সর্বাবস্থায়ই তা হারাম।
আসলে
সূদ ব্যবসা বা মুনাফা কোনটাই
নয়। সূদ হচ্ছে শোষণ
ও সম্পদ পুঞ্জিভূতকরণের মাধ্যম। কুর'আন মজীদে
এরশাদ হয়েছে:
“তারা
বলে: 'নিঃসন্দেহে ব্যবসা রিবার ন্যায়।' কিন্তু আল্লাহ্ ব্যবসাকে হালাল করেছেন ও রিবাকে হারাম
করেছেন।” (সূরা আল-বাকারা-২৭৫)
“তোমরা
রিবা হিসেবে যা কিছু দাও
যাতে লোকদের ধনসম্পদে বৃদ্ধি ঘটতে পারে, কিন্তু
আল্লাহর নিকট তা বৃদ্ধি
পায় না।” (সূরা আর-রূম-৩৯)
“হে
ঈমানদারগণ! তোমরা দ্বিগুণ ও বহুগুণ করে
রিবা খেয়ো না এবং আল্লাহকে
ভয় কর যাতে তোমরা
কল্যাণ লাভ করতে পার।”
(সূরা আলে ইমরান-১৩০)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং রিবার যে সমস্ত বকেয়া রয়েছে তা পরিত্যাগ কর যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। অতঃপর তোমরা যদি তা না কর তাহলে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের হুশিয়ারী শুনে নাও।
আর যদি
তোমরা তাওবাহ কর তবে তোমাদের
মূলধন পাবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং
তোমাদের ওপরও জুলুম করা
হবে না।” (সূরা আল-বাকারাহ
২৭৮-২৭৯)
বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত মুক্তবাজার অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে রিবা। যাকাতের মাধ্যমে যেখানে ধনীদের সম্পদের একটি অংশ গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়, তার বিপরীতে রিবা বা সূদের মাধ্যমে গরীবদের সম্পদ ধনীদের হাতে চলে যায়।
আধুনিক অর্থনীতি রিবা বা সূদের
ওপর নির্ভরশীল। ধরে নেয়া হয়
যে, সূদ বাদ দিয়ে
অর্থনৈতিক জীবন সচল রাখা
একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ইসলামী
ব্যাংক ও বিনিয়োগ কোম্পানী
সূদবিহীন লেনদেনের মাধ্যমে তাদের গ্রাহকদেরকে বিভিন্ন রকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ যে ব্যবসায়িক সাফল্য
অর্জন করেছে তা ‘সূদ ছাড়া
চলা অসম্ভব'- এ ধারণাকে মিথ্যা
প্রমাণ করেছে।
অবশ্য
এখনো সূদমুক্ত একটি পরিপূর্ণ অর্থব্যবস্থা
কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বর্তমান
যুগে অর্থব্যবস্থা একটি জটিল বিষয়।
তা সত্ত্বেও বিশ্বের বুকে সামাজিক সুবিচার
ও প্রতিটি মানুষের জন্যে সমান সুযোগ-সুবিধা
নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সূদমুক্ত
অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদেরকে কাজ করে যেতে
হবে। একটি দেশে পুরোপুরি
সূদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা কেবল তখনি সম্ভব
হতে পারে যদি সেখানে
ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে
সরকার এ উদ্দেশ্যে সুষ্ঠু
পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে।
মুসলিম
উত্তরাধিকার আইন (মীরাছ)
কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া ধনসম্পদের সুষ্ঠু ও ইনসাফ সম্মত বন্টন নিশ্চিত করার ব্যাপারে ইসলামের উত্তরাধিকার (মীরাছ) আইন এক চমৎকার ব্যবস্থা। ইসলামের উত্তরাধিকার আইনে মৃতব্যক্তির স্বজনদের অধিকার ও তাদের প্রত্যেকের অংশ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। (সূরা আন্-নিসা'-৭-১২ ও ১৭৬)
অবশেষেঃ
মানুষের অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধে ইসলাম আরো বহু বিধিবিধান ও দিকনির্দেশ দিয়েছে। একটি ইসলামী রাষ্ট্রে সকল মানবিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ও কল্যাণকর ব্যবহার অপরিহার্য।
সকল প্রকার দুর্নীতি
ও অনৈতিক কার্যকলাপের মূলোৎপাটন করতে হবে যদিও
দৃশ্যতঃ অথনৈতিক দিক থেকে তা
আকর্ষণীয়। রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর
কল্যাণের স্বার্থে কিছু কিছু ব্যক্তিস্বাধীনতা
কুরবানী বা ত্যাগ করা
জরুরী হতে পারে।
ইসলাম
মানুষকে সহজ-সরল
জীবন
যাপন,
নম্রতা,
নমনীয়তা,
দান-ছাদাকাহ,
পারস্পরিক
সহায়তা
ও
সহযোগিতায়
উৎসাহিত
করে
এবং
কার্পণ্য,
লোভ-লালসা,
অমিতব্যয়
ও
অপচয়ে
নিরুৎসাহিত
করে।
আমরা
এখানে ইসলামী অর্থনীতির প্রধান দিকগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করলাম। এ বিষয়ে এর
চেয়ে বেশী আলোচনা করা সম্ভব নয়। ইসলামী অর্থনীতি
সম্পর্কে বহু বই- পুস্তক
রয়েছে, আগ্রহী পাঠক-পাঠিকারা সেসব
বই-পুস্তক পড়ে এ ব্যাপারে
বিস্তারিত জ্ঞানার্জন করতে পারেন।
পোস্ট ট্যাগঃ
ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য
ইসলামী অর্থনীতি বলতে কি বুঝ
ইসলামী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য