সুদখোরের শাস্তি
সুদখোরের শাস্তি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমি সপ্তম আসমানে পৌঁছে উপরের দিকে তাকালাম।
সেখানে
বিদ্যুতের চমক ও গর্জন
হচ্ছিল। আমি সেখানে এমন
কয়েকজন লোককে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলাম,
যাদের পেট ছিল ঘরের
মত বিশাল ও মোটা। সেই
পেটগুলো ছিল সাপে পরিপূর্ণ,
আর সাপগুলো বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিবরাইল আঃ কে জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা সে বলল, এরা হচ্ছে সূদখোর।'
(তারগীব ও তারহীব, মুনসাদে
আহমদ, ইবনে মাজা)
সামুরা বিন জুন্দুব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আজ রাতে আমি দেখলাম, দু'জন লোক আমার কাছে এলো এবং আমাকে বায়তুল মুকাদ্দাসে নিয়ে গেল। সেখান থেকে আমরা উপরের দিকে উঠতে উঠতে শেষে এক রক্ত নদীর তীরে পৌঁছে যাই। সেই নদীর মধ্যে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিল। নদীর তীরে পাথর হাতে দাঁড়িয়েছিল অন্য একজন।
রক্ত নদীতে পড়ে থাকা লোকটি তীরে উঠার জন্য অগ্রসর হলে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার মুখে পাথর মেরে মেরে তাকে আবার আগের জায়গায় পাঠিয়ে দিত। লাগাতার এমনটিই হচ্ছিল। নদীর লোকটি নদী থেকে কূলে উঠার চেষ্টা করছিল আর তীরের লোকটি কিছুতেই
তাকে তীরে উঠতে
দিচ্ছিল না। যখনই সে
তীরে আসতো তাকে পাথর
মেরে ফেলে দেয়া হতো
নদীতে। আমি জিবরাঈল আলাইহিস
সালামকে জিজ্ঞেস করলাম, 'যাকে আমি নদীর
মধ্যে দেখতে পাচ্ছি সেই ব্যক্তিটি কে?'
তিনি উত্তরে বললেন, 'এ ব্যক্তি পৃথিবীতে
সুদ খেতো”।
সুদখোরের পরিণতি অসচ্ছল বানায়
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
“নবীজি বলেছেন, 'সূদের অর্থ জমা করার
পরিণাম হচ্ছে অসচ্ছলতা।” অন্য এক বর্ণনায়
বলা হয়েছে, ‘সুদের অর্থ যতই অধিক
হোক না কেন অবশেষে
তার পরিণতি হয় অসচ্ছলতা।” (তারগীব
ও তারহীব, ইবনে মাজা ও
হাকিম)
ঋণদানের ফজিলত
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু কর্তৃক বর্ণিত, “নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'প্রতিটি ঋণই সদকা সমতুল্য।'
- ব্যাখ্যাঃ অবস্থাপন্ন ব্যক্তি যদি কোন দরিদ্রকে কর্জ দেয় তবে এটা একটা পুণ্যের কাজ এবং এর জন্য কর্জদাতা আল্লাহর কাছে পুরস্কার পাবে। কেননা কর্জদাতা দরিদ্রের বিপদ দূর করে দিয়েছেন সুতরাং কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা কর্জদাতার বিপদ দূর করে দেবেন।
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু কর্তৃক বর্ণিত, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'কোন মুসলমান অন্য
মুসলমানকে একবার কর্জ দিলে সে
সেই অর্থ দু'বার
আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয় করার
সমান সওয়াব পাবে।
হযরত
হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের পূর্বে যে সব লোক
(মুসলমান) মারা গেছেন তাদের
একজনের কাছে ফেরেশতা গিয়ে
প্রশ্ন করল, 'তুমি কি পৃথিবীতে
কোন ভাল কাজ করেছো, লোকটি বলল না।
ফেরেশতা
বলল, 'স্মরণ করো। ভাল করে
মনে করে দেখো, যদি
কোন ভাল কাজ করে
থাকো তা আমাকে বলো।'
লোকটি বলল, 'আমি মানুষকে কর্জ
দিতাম। আমার কর্মচারীদের আমি
বলে দিয়েছিলাম, যদি অভাবের কারণে
নির্দিষ্ট সময়ে কেউ ঋণ শোধ
করতে না পারে তবে
যেন তার সময় আরও
বাড়িয়ে দেয়া হয়। আর কর্জ
আদায়ে সক্ষম ব্যক্তির প্রতিও যেন কোমল ব্যবহার
করা হয়।'
নবীকরীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (এ কথা শুনে)
আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের হুকুম দিলেন, 'ওর সব ত্রুটি
ক্ষমা করে দাও।” (তারগীব,
বোখারী)
- ব্যাখ্যাঃ এমনও হয়, আল্লাহতায়ালা তাঁর কোন বান্দার কোন বিশেষ কাজকে এতটাই পছন্দ করেন যে, তার সেই পছন্দনীয় কাজের খাতিরে তার অন্যান্য সমস্ত গোনাহ আল্লাহতায়ালা ঢেকে দিয়ে তাকে জান্নাত দান করবেন। আরও অনেক হাদীসে এ রকম বর্ণনা আছে। কে জানে কখন কোন বান্দার কোন কাজ আল্লাহতায়ালা পছন্দ করে বসবেন।
হযরত বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, 'কোন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোন অভাবী ব্যক্তিকে ঋণ দিলে সেই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর্জ দাতার আমলনামায় প্রতিদিন একটি করে দানের পুণ্য লেখা হবে।
আর
নির্দিষ্ট সময়ে ঋণগ্রহীতা ঋণ আদায় করতে
না পারলে ঋণদাতা যদি তাকে আরও
সময় বাড়িয়ে দেন তবে ঋণদাতার
আমলনামায় প্রতিদিন দুটি করে দানের
পূণ্য লেখা হবে।” (মুসনাদে
আহমদ)
উত্তরাধিকার সম্পত্তি বন্টন
হযরত সালিম তাঁর পিতা আবদুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, “সাকাফী গোত্রের গিলান ইবনে সালামা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর দশজন স্ত্রী ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, 'তুমি এদের মধ্য থেকে চারজনকে বিবি হিসাবে বেছে নাও। বাকী ছয়জনকে বিদায় করে দাও।
গিলান ইবনে সালামা রাদিয়াল্লাহু হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময় নিজের সেই চার বিবিকেও তালাক দিয়ে দেন এবং তাঁর সমস্ত সম্পদ নিজের চাচাদের মধ্যে বন্টন করে দেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ খবর পেয়ে গিলান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন, 'আমার মনে হয় শয়তান উপরে উঠে তোমার মৃত্যুর খবর জোগাড় করে ফেলেছে।
তারপর সে এসে তোমাকে বলেছে যে, তুমি আর বেশিদিন বাঁচবে না। (এ জন্যই তুমি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে তোমার বিবিদের তালাক দিয়ে সমস্ত সম্পদকে নিজের বাপের ভাইদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছো)। আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, তোমাকে তোমার বিবিদের ফিরিয়ে নিতে হবে এবং ভাগ করে দেয়া সম্পদ ফেরত নিতে হবে।
নইলে
আমি জোরপূর্বক তোমার বিবিদেরকে তোমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবো আর হুকুম
দেবো, যেভাবে আবু রিগালের কবরের
ওপর পাথর মারা হয়
সেভাবেই লোকেরা যেন তোমার কবরের
উপরও পাথর নিক্ষেপ করে।”
(মুসনাদে আহমদ)
- ব্যাখ্যা: আল্লাহতায়ালা নিজ কিতাবে উত্তরাধিকারের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কোন কারণে উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। এই অনধিকার চর্চা করা মহাপাপ। ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে কেউ এমন করলে ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে, এমন গর্হিত কাজকে প্রশ্রয় ও কার্যকরী হতে না দেয়া। পাথর মারার শাস্তি অভিশপ্ত ব্যক্তিকে দেয়া হয়ে থাকে।
এই
হাদীস থেকে জানা গেল,
কাউকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা
পাপ এবং এরাও অভিশপ্তদের
অন্তর্ভুক্ত। রিগাল ছিল জাহেলী যুগের
এক অভিশপ্ত ব্যক্তি। সে আবরাহার 'কাবা'
আক্রমণের সহযোগী ছিল। আবরাহা 'কাবা'
ধ্বংস করার জন্য বাহিনী
নিয়ে এলে এই ব্যক্তি
তাদের পথ প্রদর্শন করেছিল।
এ জন্যে এই অভিশপ্ত ব্যক্তির
কবরে পাথর নিক্ষেপ করা
হয়।
মানুষের প্রতি মানুষের অধিকার কয়টি গুরুত্বসহ
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমলনামায় লিখিত পাপ তিন প্রকারের হবে।
এক প্রকারের পাপ
যা আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন
না। এ হচ্ছে শিরকের
পাপ। আল্লাহতায়ালা সূরা নিসার ৪৮
নং আয়াতে এরশাদ করেছেন, (তাঁর সত্তা, গুণ,
অধিকার ও ক্ষমতায়) তাঁর
সঙ্গে কাউকে তুল্য ও অংশীদার গণ্য
করার পাপকে আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না।
আমলনামায়
লিখিত দ্বিতীয় প্রকার পাপ হবে বান্দার
হক সম্পর্কিত। বান্দার হক নষ্টকারী ব্যক্তি
যার অধিকার নষ্ট করেছে সেই
হক ফিরিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে
মাফ না লওয়া পর্যন্ত
আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন
না।
আমলনামায়
লিখিত তৃতীয় প্রকার পাপ হবে বান্দা
ও খোদার মধ্যকার সম্বন্ধ ও অধিকার সম্পর্কিত।
এগুলো আল্লাহতায়ালা নিজ দায়িত্বে এভাবে
রেখেছেন, ইচ্ছা করলে তিনি শাস্তি
দেবেন, ইচ্ছা করলে ক্ষমা করে
দেবেন। (মিশকাত)
হযরত
আব্বাস বিন মিরদাস রাদিয়াল্লাহু
আনহু কর্তৃক বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার সন্ধ্যায় নিজ উম্মাতের জন্য
দোয়া করেন। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এর
জওয়াব আসে, ‘তোমার দোয়া আমি কবুল করলাম,
তোমার উম্মতের পাপ আমি ক্ষমা
করে দেবো। তবে যারা অন্যের
হক আত্মসাৎ করেছে তাদের মুক্তি নেই। আমি জালিমের
কাছ থেকে মজলুমের হক
অবশ্যই আদায় করবো।” (ইবনে মাজাহ)
- ব্যাখ্যা: এ হাদীসের ভাষা থেকে আল্লাহর ক্ষমা প্রদান সম্পর্কে যেন ভুল ধারণার সৃষ্টি না হয়। আল্লাহ তায়ালার শাস্তি দানের বিধি ও ক্ষমা দানের বিধি উভয়টাই বিস্তারিতভাবে কোরআন ও হাদীস বিবৃত হয়েছে, যা জানার জন্য এখানকার হাদীস সমষ্টিই যথেষ্ট।
পোস্ট ট্যাগঃ