দান ও সদকার পার্থক্য
দান ও সদকার পার্থক্য
দান
ও সদকা একই বিষয় বুঝিয়ে থাকে। তাই দান ও সদকার মধ্যে নীতিগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই
বলে প্রতীয়মান হয়। নিম্নে দান ও সদকার বিষয়ে বিষদ আলোচনা করা হলো।
সদকার ব্যাপক
ধারণা
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজাদ করা গোলাম
সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত,
“পূণ্য ও পুরস্কার লাভের
পক্ষে সেই দীনার সব
থেকে উত্তম যা মানুষ তার
নিজের সন্তান-সন্তুতি ও পোষ্যজনের জন্য
ব্যয় করে এবং সেই
দীনার যা মুজাহিদ তার
ঘোড়ার জন্য ব্যয় করে,
যার উপর যে সাওয়ার
হয়ে জিহাদ করে এবং সেই
দীনারও যা মানুষ তার
সংগী মুজাহিদদের জন্য ব্যয় করে।
বর্ণনাকারী
আবু কিলাবা বলেন, 'দেখো, সন্তান-সন্ততির জন্য যে দীনার
ব্যয় করা হয় তার
উল্লেখ করা হয়েছে সর্ব
প্রথম।' এরপর আবু কিলাবা
আরও বলেন, 'সেই ব্যক্তির থেকে
পূণ্য ও পুরস্কার লাভের
যোগ্যতার আর কে হতে
পারে, যে নিজের ছোট
কমজোর সন্তান-সন্ততির জন্য ব্যয় করে,
ফলে তারা অন্যের দ্বারে
ভিক্ষা করা থেকে রক্ষা
পায়।” (মুসলিম, তিরমিযী)
হযরত
মিকদাম ইবনে মা'দিকারিব
রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যে খাদ্য তুমি
খাও তা তোমার জন্য
সদকা, যে খাদ্য তোমার
নিজের সন্তান-সন্ততিকে খাওয়াও তাও সদকা, যা
তুমি তোমার স্ত্রীকে খাওয়াও তাও সদকা, যা
তোমার চাকরকে খাওয়াও তাও সদকা।” (তারগীব
ও তারহীব
হযরত
জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'কোন মুসলমান গাছ
রোপন করলে তার ফল
যদি কোন পাখি খায়
বা কোন মানুষ খায়
তবে তার সাওয়াব সে
ব্যক্তি পাবে। তার আমলনামাতে তা
সাদকা বা দানরূপে লেখা
হবে। তেমনি, বাগানের ফল যদি চোরে
চুরি করে নিয়ে যায়,
বা কেউ ছিনতাই করে
নিয়ে যায়, তবে উদ্যান-কর্তার
আমলনামায় তাও সাদকারূপে কেয়ামত
পর্যন্ত লেখা হতে থাকবে।”
- ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসে বৃক্ষরোপণ অর্থাৎ বাগান করার কথা আছে। অন্য হাদীসে এর সঙ্গে ক্ষেত চাষেরও উল্লেখ আছে। কেউ ফলের গাছ রোপণ করতে বা শস্য চাষ করতে অর্থ ব্যয় ও পরিশ্রম করে; তারপর গাছে ফল ফললে বা শস্য জন্মালে পশু-পাখি কিছু খেয়ে নেয়, ক্ষুধার্ত গরীব লোকও তার দ্বারা উপকৃত হয় বা চোর চুরি করে বা কেউ বলপূর্বক কেড়ে নেয়, বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় এগুলো সব নষ্ট হলো।
- কিন্তু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'না, তা নষ্ট হয় না; এর জন্য পূণ্য ও পুরস্কার পাওয়া
গোলাম আযাদ
করা
ও
ইয়াতীমের
প্রতি
সদ্ব্যবহার
করার
ফজিলত
হযরত মালিক বিন হারিস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, 'যে ব্যক্তি তার মুসলমান মাতা-পিতার ইয়াতীম সন্তানকে লালন-পালন করে স্বাবলম্বী করে দেবে সে অবশ্যই জান্নাত লাভ করবে।
আর
কেউ কোন মুসলামন গোলামকে
মুক্ত করলে এ কাজ
তার জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার
উপায় হয়ে যাবে। গোলামের
প্রতি অংগের পরিবর্তে তার অংগসমূহ জাহান্নাম
থেকে রক্ষা পাবে।” (তারগীব ও তারহীব-মুসনাদে
আহমদ)
কার সদকা
কবুল
হবে
না
হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'সেই সত্তার কসম, যিনি আমাকে সত্য-দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন। কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা সে সব লোকদের আজাব দেবেন না,
যারা পৃথিবীতে ইয়াতীমদের প্রতি রহম করেছে, তাদের
সাথে কোমলভাবে কথা বলেছে, তাদের
অভিভাবকহীনতা ও অসহায়ত্বের কারণে
তাদের প্রতি হৃদয়ে সহানুভুতি রেখেছে এবং নিজের সম্পদের
প্রাচুর্য নিয়ে প্রতিবেশীর সামনে বড়াই করে বেড়ায়নি।'
হুজুর
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন, 'হে
মোহাম্মাদের উম্মত, সেই সত্তার কসম,
যিনি আমাকে সত্য-দ্বীন সহকারে
পাঠিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা সেই ব্যক্তির দান-সদকা কবুল করবেন
না, যার আত্মীয়-স্বজন
তার আত্মীয়তার হকের মুখাপেক্ষী থাকা
সত্ত্বেও তাদের না দিয়ে অন্যদের দান করে। (তাবরানী)
অন্য
হাদীসের ভাষ্য নিম্নরূপঃ 'সেই সত্তার কসম,
যাঁর মুঠিতে আমার প্রাণ, এমন
ব্যক্তির দিকে আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের
দিন অনুগ্রহের দৃষ্টিতে তাকাবেন না।'
মহানবীর এগারোটি
অসীয়ত
হযরত
মোয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
“নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরলেন।
কিছু দূর চলার পর
বললেন, 'হে মোয়াজ, আমি
তোমাকে নিম্নোক্ত বিষয়:
- ১. আল্লাহর নাফরমানি থেকে বিরত থাকা।
- ২. সত্য কথা বলা।
- ৩. অঙ্গীকার পূর্ণ করা।
- ৪. আমানত যথাযথভাবে আদায় করা।
- ৫. খিয়ানত না করা।
- ৬. ইয়াতীমের প্রতি রহম করা।
- ৭. প্রতিবেশীর হক রক্ষা করা
- ৮. ক্রোধ বা রাগ দমন করা।
- ৯. মানুষের সাথে নরমভাবে কথা বলা।
- ১০. মানুষকে সালাম দেয়ার জন্য অসিয়ত করছি। আর এ অসিয়তও করছি, সব সময়
- ১১. নেতৃবৃন্দের সাথে লেগে থাকবে। (তাঁদের থেকে পৃথক হবে না এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দল পাকাবে না)। (বায়হাকী, তারগীব ও তারহীব )
ব্যাখ্যাঃ যদি ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী নেতৃত্ব সমাজে না থাকে তাহলে কার সঙ্গে লেগে থাকবে? বাতিলের সংগে? বাতিলপন্থী দলের সংগে? না, কখনও না। তবে কি বিচ্ছিন্নভাবে ভেড়াদের ন্যায় জীবন যাপন করবে? না। তবে কি করা হবে? এর উত্তর হচ্ছে: জামায়াতবদ্ধ হও। জামায়াতবদ্ধভাবে দ্বীনের দাওয়াত দাও। যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহতায়ালার বরকতে তোমাদের প্রচেষ্টা সফল হয় দ্বীনের পরিবেশ প্রভাব ও আধিপত্য সৃষ্টি হয় অথবা সেই প্রচেষ্টায় তোমার মৃত্যু আসে। এ মৃত্যু কতই না মর্যাদার ও কতই না উত্তম।
হারাম কামাই হবে মানুষের জাহান্নামের সম্বল
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'গৌরব ও মর্যাদার অধিপতি আল্লাহতায়ালা তোমাদের মধ্যে যেভাবে রুজি বন্টন করে দিছেন তেমনি তিনি তোমাদের আখলাকও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা দুনিয়া সবাইকে দান করেন। যে তাঁর প্রিয় তাকেও দেন এবং যে তাঁর অপ্রিয় তাকেও দেন।
কিন্তু তিনি
দ্বীনের উপর চলার তাওফীক
দান তাদেরকেই দেন যাদের তিনি
ভালবাসেন। সুতরাং যাকে আল্লাহতায়ালা দ্বীনের
পথে চলার তৌফিক দিয়েছেন
তোমরা জানবে আল্লাহতায়ালা তাকে ভালবাসেন।
সেই আল্লাহর কসম যাঁর হাতে
আমার জীবন, কোন বান্দা মুসলমান
হতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত
না তার জবান ও
অন্তর মুসলমান হবে। আর কেউ
মুমিন হতে পারে না
যতক্ষণ না তার প্রতিবেশী
তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ ও
নিশ্চিন্ত হয়।'
লোকেরা
প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাঃ), কেমন
অনিষ্ট থেকে?
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, 'প্রতিবেশীর হক নষ্ট করাই তার ওপর জুলুম। আর যে বান্দা হারাম মাল অর্জন করে আল্লাহতায়ালা তাকে বরকত থেকে বঞ্চিত করবেন। সে আল্লাহর পথে ধনসম্পদ দান করলেও আল্লাহ তা কবুল করবেন না।
আর যদি কেউ হারাম
সম্পদ দুনিয়ায় রেখে পরকালের যাত্রী
হয় তবে তাই তার
জাহান্নামের পাথেয় হবে। আল্লাহতায়ালা মন্দকে
মন্দ দ্বারা মিটান না; তিনি খারাপকে
ভাল দ্বারা মিটিয়ে দেন। কারণ মন্দ
দ্বারা কখনো মন্দ দূর
হয় না। (তারগীব ও
তারহীব)
- ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসের শেষ বাক্যের মর্ম হচ্ছে, হারাম মাল আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলে তা সদকা বা দানরূপে গণ্য হবে না এবং তাতে কোন পূণ্যও হবে না। তাতে আল্লাহতায়ালার ক্রোধ প্রশমিত হবে না। মন্দকে মেটাতে হলে হালাল উপায়ে উপার্জিত ধন খোদার রাস্তায় ব্যয় করতে হবে। নিজের আত্মার কলুষতা ও অপবিত্রতা কখনো অপবিত্র ধন দ্বারা দূর করা সম্ভব নয়।
পোস্ট ট্যাগঃ