আল্লাহর স্মরণে অন্তর প্রশান্ত হয়
আল্লাহর স্মরণে অন্তর প্রশান্ত হয়
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি তোমাদের খুব
বেশী করে আল্লাহকে স্মরণ
করার নির্দেশ দিচ্ছি। এই স্মরণের উপমা
এ রকম: মনে করো
এক ব্যক্তির শত্রু তার পিছনে দ্রুতগতিতে
ধাওয়া করে আসছে। সে
ব্যক্তি পালিয়ে এসে এক সুরক্ষিত
দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলো এবং শত্রুর
হাত থেকে বেঁচে গেলো।
ঠিক তেমনি আল্লাহর স্মরণ-দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ না করলে বান্দা
শয়তানের হাত থেকে পরিত্রাণ
পেতে পারে না।
- ব্যাখ্যা: আল্লাহর স্মরণ কথাটির অর্থ হলো, তাঁর সত্তা ও গুণাবলী, তাঁর মহত্ব ও পরাক্রম, তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ এবং তাঁর পাকড়াও ও প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা অর্থাৎ আল্লাহর সমগ্র গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্ক সচেতন থাকা। যদি এ অনুভূতি ও সচেতনতা জীবন্ত ও শক্তিশালী হয় তাহলে মানুষ অদৃশ্য শত্রু ইবলীসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারবে।
- সর্বদা আল্লাহকে স্মরণে রাখার বাস্তব উপায় হলো, ঠিক ঠিকভাবে ফরয নামায আদায় করা, নফল নামায- বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামায পড়া, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিন ও রাত্রির বিভিন্ন সময়ের জন্যে যে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন তা মুখস্ত করে সেগুলো আমল করা, পঠিত দোয়া ও তসবির অর্থ ও তাৎপর্য বুঝে নিয়ে তা বার বার পড়তে থাকা। এই হলো সেই সুরক্ষিত দূর্গ, যার মধ্যে আশ্রয় নিলে শয়তানের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
হযরত
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু
আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আল্লাহর স্মরণ ও আলোচনায় এতটাই
মশগুল থাকো, যেন লোকেরা বলতে
থাকে, ও তো একটা
পাগল!” (মুসনাদে আহমদ)
স্বরণ ও
দোয়ার
মাধ্যমে
আল্লাহর
নৈকট্য
লাভ
- ব্যাখ্যা: এর অর্থ হলো, আল্লাহর স্মরণ ও দ্বীনী কাজ এমন একাগ্রতার সঙ্গে করতে থাকো যেন লোকেরা বুঝতে পারে তুমি দ্বীনের পথে এক পাগলপারা সৈনিক। এটা খুব পরিষ্কার কথা যে, দ্বীনের কাজে মানুষ যখন মনে প্রাণে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, তার কর্ম তৎপরতা আল্লাহর দ্বীন অনুযায়ী হবে এবং হারাম ও হালাল বেছে জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত করবে, তখন পার্থিব দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি, যাদের সামনে আখেরাত ও জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা নেই, তারা তাকে পাগলই ভাববে।
স্মরণকারীর বিষয়ে
আল্লাহ
ও
ফেরেশতাদের
মধ্যে
কথোপকথন
হযরত
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোথায় কোন্ লোক আল্লাহকে
স্মরণ করছে তা দেখার
জন্যে আল্লাহর কিছু ফেরেশতা অলিগলি
ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন। যখন তারা কিছু
লোককে আল্লাহর স্মরণ করতে দেখে তখন
একে অপরকে ডেকে বলে, 'এখানে
এসো, যাদের তোমরা খুঁজছো তারা এখানে।' তখন
তাঁরা এ রকম লোককে
আকাশ পর্যন্ত নিজের পাখায় ঢেকে নেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'তাদের প্রভু যদিও নিজেই খুব ভাল করে জানেন তারা কি করছে, তবু তিনি ফেরেশতাদের বললেন, 'আমার এসব বান্দারা কি করছে?' ফেরেশতাগণ জবাবে বললেন, ‘এরা আপনার তাসবীহ করে, আপনার মাহত্ম বর্ণনা করে, আপনার প্রশংসা করে ও শোকর আদায় করে। এরা আপনার প্রজ্ঞা ও পরাক্রম বর্ণনা করে।'
তখন আল্লাহ জিজ্ঞেস
করলেন: 'ওরা কি আমাকে
দেখেছে? ফেরেশতাগণ বললেন, 'না, হে আমাদের
প্রভু! আপনার শপথ, এরা আপনাকে
দেখেনি।' আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, 'ওরা যদি আমাকে
দেখতো তাহলে কি অবস্থা হতো?'
ফেরেশতাগণ
বললেন, 'এরা যদি আপনাকে
দেখতো তাহলে এরা আরো বেশী
তৎপরতার সঙ্গে আপনার ইবাদত করতো। আরো বেশী করে
আপনার প্রজ্ঞা বর্ণনা করতো এবং তাসবীহ
করায় মগ্ন হয়ে যেতো।'
তারপর
আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, 'আমার এই সব
বান্দা আমার কাছ থেকে
কি চায়?' ফেরেশতাগণ বললেন, 'এরা আপনার কাছ
থেকে জান্নাত চায়।' আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওরা কি জান্নাত
দেখেছে?'
ফেরেশতাগণ
জবাব দিলেন, 'না, হে আমাদের
প্রভু! এরা জান্নাত দেখেনি।'
আল্লাহ বললেন, 'যদি ওরা জান্নাত
দেখতো তাহলে এদের আগ্রহের কি
অবস্থা হতো?' ফেরেশতাগণ বললেন, 'এরা যদি জান্নাত
দেখতে পেতো তাহলে এদের
আগ্রহ ও উদ্দীপনা আরো
বেড়ে যেতো এবং তা
পাবার আকাঙ্খা ও তার প্রতি
আকর্ষণ তাদের তীব্রতর হয়ে যেতো।
তারপর আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, 'ওরা আমার কাছে কি থেকে আশ্রয় চায়?' জবাবে ফেরেশতাগণ বললেন, 'এরা জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চায়।' আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, 'ওরা কি জাহান্নামের আগুন দেখেছে।' ফেরেশতাগণ বললেন, ‘না, আল্লাহর শপথ! এরা জাহান্নাম দেখেনি।'
আল্লাহ বললেন, 'যদি ওরা জাহান্নাম
দেখতে পেতো তাহলে এদের
কি অবস্থা হতো?' ফেরেশতাগণ বললেন, 'এরা যদি জাহান্নামের
আগুন দেখতে পেতো তাহলে আরো
প্রচণ্ড ভীতি তাদের আচ্ছন্ন
করতো এবং যে কাজ
মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যায় তা থেকে
ছুটে পালাতো।
তখন
আল্লাহ বললেন, 'আমি তোমাদেরকে সাক্ষী
রেখে বলছি, আমি ওদের মাফ
করে দিয়ে আপন আশ্রয়ে নিয়ে
নিলাম।' ফেরেশতাদের মধ্য থেকে এক
ফেরেশতা বললেন, 'অমুক ব্যক্তি এদের
মধ্যে ছিল না। সে
তো অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে
এখানে এসেছিল। এখানে এসে সে এদের
সঙ্গে মিশে আল্লাহর স্মরণকারী
হয়ে যায়।' জবাবে আল্লাহতায়ালা বললেন, 'ওরা এমন লোক,
যাদের সঙ্গে বসলে কেউ ব্যর্থ
ও অকৃতকার্য হয় না। সেও
সৌভাগ্যের অংশীদার হয়ে যায়।' (বোখারী)
আল্লাহর দৃষ্টিতে
স্মরণকারী
হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'পাক পবিত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, 'আমার বান্দা আমার কাছ থেকে যে আশা করে ও আমার সম্পর্কে যে রকম ধারণা পোষণ করে আমাকে সে ওরকমই পাবে। যখন সে আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সঙ্গী হই।
সে যদি
নিভৃতে আমাকে স্মরণ করে তাহলে আমিও
তাকে নিভৃতে স্মরণ করি, আর সে
যদি কোন দলের মধ্যে
বসে আমাকে স্মরণ করে তাহলে আমি
তাকে তার থেকে উত্তম
দলের মধ্যে স্মরণ করি। সে যদি
আমার দিকে এক বিঘত
এগিয়ে আসে তাহলে আমি
তার দিকে এক হাত
এগিয়ে যাই; আর সে
যদি আমার দিকে এক
হাত এগিয়ে আসে তাহলে আমি
তার দিকে চার হাত
এগিয়ে যাই। আর সে
যদি আমার দিকে ধীরে
ধীরে হেঁটে আসে তাহলে আমি
তার দিকে দৌড়ে যাই।
(বোখারী, মুসলিম)
- ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসে বান্দা বলতে মোমিন বান্দাকে বুঝান হয়েছে। আল্লাহ সম্পর্কে মোমিন বান্দার বিশ্বাস হলো, তিনি রহমান ও রাহীম, অতিশয় দয়ালু ও ক্ষমাকারী। সে আল্লাহর সমস্ত গুণাবলীর উপর বিশ্বাস রাখে বলে আল্লাহ বলেন, সে আমার সম্পর্কে যে বিশ্বাস রাখে আমাকে সে রকমই পাবে। আমি তার উপর রহমত বর্ষণ করবো, আমার রহমতের চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে নেবো,দুনিয়া ও আখেরাতে আমি তার হাত ধরবো।
দোয়া করার
নিয়ম
হযরত
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
“তিনি বলেন, “বান্দার দোয়া সর্বদাই কবুল হয়; অবশ্য
যদি সে দোয়া গোনাহ
করা ও সম্পর্ক ছিন্ন
করার জন্য না হয়,
আর 'জলদি বাজী' বর্জন
করা
লোকেরা
জিজ্ঞেস করল, 'হে রাসূলুল্লাহ! জলদি-বাজী করার অর্থ
কি?' তিনি বললেন, ‘দোয়াকারী
এ রকম মনে করতে
থাকে যে, সে অনেক
দোয়া করেছে কিন্তু মঞ্জুর হয়নি। তাই সে ক্লান্ত
হয়ে পড়ে এবং দোয়া
করা ছেড়ে দেয়।” (মুসলিম)
দোয়া কবুলের
তিনটি
রূপ
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যখন কোন মুসলমান দোয়া করে এবং তাতে পাপের প্রার্থনা থাকে না এবং আত্মীয়-স্বজনের অধিকার হরণের কোন কথা থাকে না তখন আল্লাহ এ রকম দোয়া অবশ্যই মঞ্জুর করেন।
হয় এ দুনিয়াতে
তার দোয়া মঞ্জুর করে নেন এবং
তার উদ্দেশ্য পূরণ করে দেন
অথবা আখেরাতে তার জন্যে জমা
করে রাখেন; অথবা তার উপর
আসন্ন কোন বিপদকে ঐ
দোয়ার বদৌলতে সরিয়ে দেন।
সাহাবাগণ
বললেন, 'তাহলে তো আমরা অনেক
বেশী দোয়া করব।' তিনি বললেন, 'আল্লাহও
খুব বেশী দানকারী।' (তারগীব,
মুসনাদে আহমদ)
- ব্যাখ্যা: এ হাদীস দ্বারা একটা মস্ত বড় ভুল ধারণা দূর করা হয়েছে। মোমিন যখন আপন উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে পেশ করে এবং তার ধারণামতে প্রার্থনা পূরণ হয়নি, তখন সে মনে করে তার প্রার্থনা ব্যর্থ হয়েছে। আর সে আল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা করে যে, সে আল্লাহকে ডাকলেও আল্লাহ তার ডাক শোনেননি। তখন সে হতাশার শিকারে পরিণত হয়ে যায়। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক বৈধ দোয়া মঞ্জুর হয় এবং তার তিনটি রূপ আছে:
- হয় এই দুনিয়াতেই তার উদ্দেশ্য পুরণ হয়ে যায়।
- নতুবা এ দোয়া তার আখেরাতের কাজে আসে।
- অথবা তার উপর আসন্ন কোন বড় বিপদকে এ দোয়ার বদৌলতে আল্লাহর দূর করে দেন। তাই পূর্ণ আবেগ অনুভূতির সঙ্গে দোয়া করা উচিত এবং খুব বেশী দোয়া করা উচিত। আল্লাহর ভান্ডারে কোন জিনিসের কমতি নেই এবং তিনি সমস্ত দয়াময়দের উর্ধে সব থেকে বড় দয়াময়।
আল্লাহতায়ালা দোয়াকে
ব্যর্থ
হতে
দেন
না
হযরত
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আল্লাহতায়ালা লজ্জাশীল ও দানশীল। যখন
কোন বান্দা তাঁর সামনে দু'হাত পাতে তখন
তাকে ব্যর্থ করে খালি হাতে
ফিরিয়ে দিতে লজ্জা অনুভব
করেন তিনি।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী,
ইবনে মাজা)
- ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসের অর্থ সম্পূর্ণ পরিষ্কার। দুনিয়াতেও দেখা যায়, যখন কোন অভাবী ব্যক্তি কারো কাছে গিয়ে হাত পাতে তখন সে তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়া পছন্দ করে না। আল্লাহতায়ালা সব দয়াময়ের উর্ধে সব থেকে বড় দয়াময়। তাই যখন কোন বান্দা তাঁর কাছে হাত পাতে তখন তিনি তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না, বরং কোন না কোন ভাবে তার দোয়া মঞ্জুর করে নেন।
পোস্ট ট্যাগঃ