দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা

দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা

পান্ডিত্যের অহংকারকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আড়ম্বপূর্ণ জটিল শব্দ প্রয়োগকারী ধ্বংস হয়ে যাক।' এ কথা তিনি তিনবার বলেন।”

  • ব্যাখ্যাঃ এমন অনেক বক্তা আছেন, যারা বক্তৃতা করার সময় নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য অযথা আড়ম্বরপূর্ণ ও জটিল শব্দের স্রোত বইয়ে দেন। তারা মানুষকে হীন গণ্য করে নিজের যোগ্যতা দেখানোর জন্যে এরকম উপায় অবলম্বন করে থাকেন। 
  • হাদীসটিতে এ ধরনের বক্তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মূলত তাদের শিক্ষা দেয়ার জন্যই কথা কয়টি এখানে বলা হয়েছে। যেন তারা এ রকম আর না করেন সে জন্যই নবীজী তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন তাদের ভাষা সহজ ও স্বতঃফুর্ত হয়। আমি একজন মস্ত বড় বক্তা, এরকম অহংকার আল্লাহ পছন্দ করেন না। (মুসলিম)

ক্ষমা বিনয় দাওয়াত দানকারীর হাতিয়ার

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ইদফাআ বিল্লাতি হিয়া আহসান' (সূরা মুমিনুন ৯৬, হামীম ৩৪) এর তাফসীর করতে গিয়ে বলেছেন, 'দাওয়াতী কাজ যারা করে তাদের সবরকারী ও ঠান্ডা মেজাজের হওয়া উচিত। 

লোকেরা ক্রোধ উদ্রেককারী কাজ করলেও সঙ্গে সঙ্গে রাগের বদলে রাগ দেখানো উচিৎ নয়। যদি রাগ এসে যায় তাহলে তা দমন করা উচিত। যারা এমনটি করে আল্লাহতায়ালা তাদের হেফাযত করবেন আর শত্রুরা তাদের সামনে নতি স্বীকার করবে। এমনকি তারা অস্তরঙ্গ বন্ধু এবং সাথী হয়ে যাবে।” (বোখারী)

হযরত আম্মার বিন ইয়াসির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীন এবং তার আহকাম শেখানোরা জন্যে আমাকে কায়েস গোত্রের নিকট প্রেরণ করেন। সেখানে গিয়ে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারা যেন উদ্ভ্রান্ত উট। তারা দুনিয়ার স্বার্থে মত্ত। তাদের জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই। তাদের সমস্ত আকর্ষণ তাদের ছাগল ও উটের ওপর। 

তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে আসি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আম্মার, কি কাজ করে এসেছো বলো তো শুনি।' আমি তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করি। আমি তাঁকে বলি যে, “তারা দ্বীনকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে।

‘তিনি বললেন, ‘হে আম্মার, এদের থেকে অধিক বিস্ময়কর লোক হলো তারা, যারা দ্বীনের শিক্ষা লাভ করেছে কিন্তু তাদেরই মত দ্বীনকে ভুলে গেছে ও বেপরোয়া হয়ে গেছে।' (তারগীব, তাবরানী)

  • ব্যাখ্যাঃ এর অর্থ হলো, এসব মানুষ তো দ্বীন জানে না। বহুদিন যাবত এরা জাহেলিয়াতের জীবন-যাপন করে আসছে। যদি তারা দ্বীনকে ভুলেই গিয়ে থাকে তবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এতে দাওয়াত দানকারীর হতাশ হওয়াও উচিত নয়।
  • এ হাদীস থেকে এ কথাও জানা গেল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াত ও তাবলীগের জন্যে সাহাবাগণকে অন্যত্র পাঠাতেন এবং তাঁদের কাজের রিপোর্ট শুনতেন।

দ্বীনের প্রয়োজনে নতুন ভাষা শিক্ষা করা

হযরত যায়েদ বিন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সুরিয়ানী ভাষা শেখার আদেশ দেন।' অন্য এক হাদীসের বর্ণনায়, 'তিনি আমাকে ইহুদীদের ভাষা শিখাতে আদেশ দেন এবং বলেন, “ইহুদীদের লেখার উপর আমার আস্থা নেই। সুতরাং তাদের ভাষা শেখো এবং অক্ষরও শেখো।'

হযরত যায়েদ বিন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, 'আমি মাত্র ১৫ দিনে তাদের অক্ষর শিখেছি। তারপর তিনি ইহুদীদের যা কিছু বলতেন তা আমি লিখে দিতাম এবং যখন ইহুদীদের কোন পত্র তাঁর কাছে আসতো তখন আমি তাদের পত্র তাকে পড়ে শোনাতাম।”

  • ব্যাখ্যাঃ সমস্ত ভাষা আল্লাহর। দ্বীনের প্রয়োজনে সমস্ত ভাষাই শিখতে হবে দায়ীকে যেখানে সত্যের দাওয়াত দেয়া হচ্ছে সেখানকার অধিবাসীর কাছে সত্যের দাওয়াত যাতে তাদের ভাষায় পৌঁছে দেয়া যেতে পারে সে জন্যে সেখানকার ভাষাও শিখতে হবে। এভাবে সাংস্কৃতিক অগ্রগতির উপায়-উপরকরণও দাওয়াত দানকারী দলকে কাজে লাগাতে হবে।

দাওয়াত দানকারীর গুণাবলী

একসময় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহুআনহু বলেন, “আল্লাহ সে সব মহিলাদের উপর অভিশম্পাত করেছেন, যারা নিজের (হাতে পায়ে) ছবি খোদাই করে নেয়, অন্যের (হাতে পায়ে) খোদাই করে দেয় এবং স্থায়ী উল্কি আঁকে।

সে সব মহিলাদের উপরও অভিশম্পাত করেছেন, যারা সৌন্দর্যের জন্যে চুল কেটে ছোট করে আর সে সব মহিলাদের উপরও যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে নিজেদের দাঁতের মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর সৃষ্ট শারীরিক গঠনকে বিকৃত করে দেয় ৷'

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু এ কথা বলার পর উম্মে ইয়াকুব নামে এক পর্দানশীল মহিলা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহুর কাছে হাজির হয়ে বললেন, 'আমি জানতে পারলাম আপনি এ রকম কথা বলেছেন?'

তিনি বললেন, 'আল্লাহর কিতাব এবং রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার উপর অভিম্পাত করেছেন আমি কেন তার উপর অভিসম্পাত করবো না?

উম্মে ইয়াকুৰ বললেন, 'আমি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কোরআন পড়েছি, কিন্তু এ বিষয়ের কোন কথা তো পাইনি।'

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু বললেন, 'যদি তুমি মনোযোগের সঙ্গে কোরআন পড়তে তাহলে এ বিষয় কোরআনের মধ্যেই পেতে। তুমি কি কোরআন শরীফের এ আয়াত পড়োনি, তা থেকে শেষ পর্যন্ত।) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে যা দেন তা গ্রহণ করো আর যা থেকে বিরত করেন তা করো না)

উম্মে ইয়াকুব বললেন, 'হ্যাঁ, এ আয়াত আমি পড়েছি।'

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু বললেন, 'আমি যেসব কথা বলেছি তা নবীজী নিষেধ করেছেন।'

‘উম্মে ইয়াকুব বললেন, 'আমার মনে হয়, আপনার স্ত্রী গণ এ রকম করেন।'

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, 'ভিতরে যাও, গিয়ে দেখে এসো।'

'তারপর তিনি ভিতরে যান এবং দেখেন যে এ সব ত্রুটি তাদের মধ্যে নেই । তখন তিনি ফিরে এসে বললেন, 'আমার ধারণা ভুল, আপনার স্ত্রীগণ এসব করেন না ।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, 'যদি আমার স্ত্রীগণ এসব করতো তাহলে তারা আমার সঙ্গে থাকতে পারতো না।'

অন্য হাদীসের বর্ণনায় এসেছে, উম্মে ইয়াকুব ভিতরে যান এবং ফিরে এসে বলেন, 'আপনার স্ত্রীগণ এ ধরনের সাজ ও সৌন্দর্য চর্চা থেকে দূরে আছেন।' আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, 'নেক বান্দা (শোআয়েব) যে কথা বলেছিলেন তা কি তোমার মনে নেই? তিনি বলেছিলেন,

'যা থেকে আমি তোমাদেরকে বিরত করছি আমি নিজে তা করবো এরকম উদ্দেশ্য আমার নয়।' (সূরা হুদ, আয়াত নং ৮৮)। (মুসনাদে আহমদ)

  • ব্যাখ্যাঃ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের ঘটনার মধ্যে দাওয়াতী কাজ যারা করেন তাঁদের জন্যে খুব বড় শিক্ষার বিষয় আছে। বাইরের লোকদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পূর্বে নিজের ঘরের লোকদের ও নিকটবর্তী লোকদের কাছে দাওয়াত দেয়া উচিত এবং তাদের শিক্ষা দেয়া উচিত। তা না হলে তার দাওয়াতের প্রভাব পড়বে না।

বাতিলের প্রাধান্যের সময় হকপন্থীদের করণীয়

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সমাজের মধ্যে কোন মন্দ কাজ দেখেছে এবং শক্তি প্রয়োগ করে তা দূর করে দিয়েছে সে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। 

আর যে ব্যক্তি শক্তিশালী না হবার কারণে জিহ্বাহ ব্যবহার করেছে এবং তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে সেও নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। আর যে ব্যক্তি জিহ্বাহ ব্যবহার করতে পারেনি তবে অন্তর থেকে সেই মন্দ কাজকে ঘৃণা করেছে এবং তা মন্দ মনে করেছে সেও পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে। আর এ হলো ঈমানের সব থেকে দূর্বল অবস্থা।” (তারগীব ও তারহীব, নাসাঈ)

  • ব্যাখ্যাঃ এ হাদীসের তাৎপর্য হলো, শক্তি থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি মন্দ কাজকে দূর করেনি সে আল্লাহর ক্রোধের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। সুতরাং শক্তি প্রয়োগের ফলে যদি কোন অধিকতর বড় খারাবী মাথা তুলে দাঁড়াবার আশঙ্কা না থাকে তাহলে যা কিছু শক্তি যার কাছে আছে তা দিয়ে মন্দকে দূর করার চেষ্টা রাখা উচিত। 
  • এ হাদীস বলে যে, বাতিলের প্রাধান্যের যুগে সত্যপন্থীদের সত্যের জন্য জিহাদ করা উচিত। বাতিলের সামনে অস্ত্র সমর্পন করে আরামের সঙ্গে ঘুমানো এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া ঈমানী মর্যাদাবোধের অভাবের লক্ষণ এবং হকের জন্যে ভালবাসা না থাকার প্রমাণ।”

পোস্ট ট্যাগঃ

দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা
দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা pdf
দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা বই নোট
দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা নোট
বই নোট দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url