গীবত নিয়ে উক্তি
হযরত
আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'জন ব্যক্তি
সম্পর্কে বলেছেন, 'আমার ধারণা হলো
যে, অমুক ও অমুক
ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের কিছু বোঝে না।”
(বোখারী)
- ব্যাখ্যাঃ এ দু'জন ব্যক্তি কারা তাদের নাম হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেননি। আমাদের মনে হয় তারা খুব সম্ভব মুনাফিকদের মধ্যের কেউ হবে। এ হাদীস থেকে এ কথা জানা যায়, দলীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ সামষ্টিক মঙ্গলের স্বার্থে কারো ব্যাপারে সঠিক সত্য তুলে ধরলে তা গীবত হবে না। বরং বিপদজনক লোকদের সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট লোকদের সতর্ক করা জরুরী। কিন্তু এ পথ খুবই বিপজ্জনক। খুবই ভেবে-চিন্তে এতে পা রাখা দরকার।
সহকর্মীদের ব্যাপারে
কান
ভারী
করা
অন্যায়
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আমার সাহাবীদের কেউ
যেন অন্য সাহাবীর কোন
ত্রুটি আমাকে না বলে। আমি
তোমাদের পাক ও পরিষ্কার
অন্তর দেখতে পছন্দ করি।” (আবু দাউদ)
- ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ কেউ কারো ব্যাপারে কিছু বললে তাতে শ্রোতার মনে তার প্রভাব পড়তে পারে এবং এতে কোন রকম ভুল ধারণার সৃষ্টি হলে তার দায় কে নেবে? এখানে একথা মনে রাখা দরকার যে তিনি অনুসন্ধান না করে কোন কথা বলতে নিষেধ করেছেন এবং কোরআনেও বিশদভাবে এ কথা বলা হয়েছে।
দয়া প্রদর্শনের
সীমা
হযরত
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের হাতে কাউকে মারেননি।
না কোন স্ত্রীকে মেরেছেন,
না কোন গোলামকে আর
না অন্য কাউকে। তবে
হ্যাঁ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার সময় দ্বীনের
শত্রুকে অবশ্যই মেরেছেন। কিন্তু তাঁর প্রতি কষ্ট
দানকারী কোন ব্যক্তির উপর
তিনি কখনো প্রতিশোধ গ্রহণ
করেননি। তবে কেউ আল্লাহর
নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করলে
তিনি শাস্তি দিয়েছেন।” (মুসলিম)
লেনদেনে পরিচ্ছন্ন
থাকা
আদ্দা
ইবনে খালিদ ইবনে হাওযা রাদিয়াল্লাহু
আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে পাঠানো এক পত্রে লেখেন,
'আদ্দা ইবনে খালিদ ইবনে
হাওযা আল্লাহর রাসূল মোহাম্মদের কাছে থেকে একটি
গোলাম কিনেছে যার মধ্যে কোন
নৈতিক খারাবী বা খেয়ানত নেই।
এটা এক মুসলমানের সাথে
আরেক মুসলমানের লেনদেন, যাতে কোন রকম
ধোঁকাবাজী নেই।” (তিরমিযী)
লেনদেন নিয়ে
ধোঁকা
দেয়া
ও
ঝগড়া
করা
বারণ
সায়েৰ
ইবনে আবীস সায়েৰ কোন
এক সময় হুজুর সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “জাহেলিয়াতের যুগে আমরা এক
সঙ্গে ভালো ব্যবসা বাণিজ্য
করতাম। আপনি কখনো আমাকে
ধোঁকাও দেননি আর কখনো ঝগড়াও
করেননি।”
প্রতিশোধ গ্রহণ
না
করার
শিক্ষা
হযরত
উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত, “নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উম্মে সালমার
ঘরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এক বাঁদীকে
ডাকেন (সে উম্মে সালমার
বা নবীজীর বাঁদী ছিল)। বাদী
তাঁর কাছে আসতে দেরী
করে। এতে নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে রাগের চিহ্ন
প্রকাশ পায়। উম্মে সালমা তা অনুভব করে
উঠে পর্দার কাছে গিয়ে বাঁদীকে
খেলা করছে দেখতে পান।
যা হোক, তারপর বাঁদী
তাঁর কাছে আসে।
নবীজীর
হাতে ছিল একটি মিসওয়াক।
তিনি মিসওয়াকটি দেখিয়ে বললেন, 'কিয়ামতের দিন যদি তোমার
প্রতিশোধ গ্রহণের ভয় না থাকতো
তাহলে এই দাঁতন দিয়ে
আমি তোমাকে মারতাম।” (আল-আদাবুল মুফরাদ)
- ব্যাখ্যাঃ এ ক্রোধ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল, ডাকা সত্ত্বেও বাঁদী এলো না কেন? এমতাবস্থায় যদি তাকে শাস্তি দিতেন তাহলে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হবার আশঙ্কা ছিল। সে জন্য তিনি শাস্তি দেননি। আগেও এক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো নিজের জন্যে কারো উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি।
বান্দার হক
আদায়
করার
প্রতি
গুরুত্বারোপ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছ থেকে এক প্রতিশ্রুতি নিয়েছি (দোয়া কবুল করার প্রতিশ্রুতি) যা তুমি কোনক্রমে ভঙ্গ করবে না। আমিও তো একজন মানুষ! তাই মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি আমি কোন মুসলমানকে কষ্টদায়ক কথা বলে থাকি, লজ্জা দিয়ে
থাকি, অভিশাপ দিয়ে থাকি, কিংবা কাউকে মেরে থাকি তাহলে
আমার এ কাজকে সেই
অত্যাচারিতের জন্যে কিয়ামতের দিন রহমত ও
মাগফেরাতের কারণ ও তোমার
নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম করে দাও।” (বোখারী
ও মুসলিম)
- ব্যাখ্যাঃ এর দ্বারা বান্দার অধিকারের গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। যদি কাউকে অন্যায়ভাবে দুঃখ-কষ্ট দেয়া হয়ে থাকে, বা প্রহার করা হয়ে থাকে এবং নির্দিষ্টভাবে না-জানার জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়নি, সে ক্ষেত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করেছেন, তার উপর যে অত্যাচার করা হয়েছে আল্লাহ যেন সেটাকে তার মাগফেরাতের উপায় করে দেন।
এ
ঘটনা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু-ব্যাধির সময়কার ঘটনা। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুব জ্বর হয়েছিল।
মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছিল। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তিনি মাথায়
রুমাল বেঁধে রেখেছিলেন। এ অবস্থায় তিনি
ফজল বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু
আনহুকে বললেন, 'আমাকে মসজিদে নিয়ে চলো এবং সবাইকে
একত্রিত করো।'
সব
লোক উপস্থিত হলে তিনি মিম্বরের
উপর উঠে আল্লাহর হাম্দ
ও সানা পড়ার পর
বললেন, 'আমি শীঘ্রই তোমাদের
মাঝ থেকে চলে যাবো।
সুতরাং আমি যদি কারো
পিঠে কোড়ার আঘাত করে থাকি
তাহলে এই আমার পিঠ
হাজির আছে, আমার উপর
এখানেই তার প্রতিশোধ নিয়ে
নাও।
আর
যদি আমি কাউকে অন্যায়ভাবে
মন্দ কথা বলে থাকি
তাহলে আমি এখানে উপস্থিত
আছি, সে তার প্রতিশোধ
নিয়ে নিক।
আমার
কাছে যদি কারো কোন
সম্পদ থেকে থাকে তাহলে
সে তা নিয়ে নিক।
আর
আমার তরফ থেকে শত্রুতার
আশংকা যেন কেউ না
করে। কেউ যেন না
ভাবে পরে আমি এর
শোধ নিয়ে নেবো। না, এমনটি করা
আমার পক্ষে অশোভনীয়।
আমি
যাতে হাসি-খুশীর সঙ্গে
আপন প্রভুর কাছে চলে যেতে
পারি তার জন্যে তোমাদের
মধ্যে যে নিজের অধিকার
এ দুনিয়াতে আদায় করে নিবে অথবা
খুশী হয়ে ক্ষমা করে
দেবে সেই আমার সব
থেকে অধিক প্রিয়।
“হে
মানবমন্ডলী।' যে অন্যের অধিকার
ছিনিয়ে নিয়েছে সে তার অধিকার
ফিরিয়ে দিক ও তাতে
যেন দুনিয়াতে অপমানের আশংকা না করে। অন্যথায়
আখেরাতের অপমানের জন্যে তৈরী থাকো, সেখানকার
অপমান দুনিয়ার অপমান অপেক্ষা অধিকতর কঠিন হবে।
জীবনযাত্রার মান
সাদাসিধেই
রাখা
দরকার
বিলাসিতার প্রতি নয়
হযরত
সহল বিন সায়াদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়তের পর জীবনভর ময়দার
আটা দেখেননি। যখন থেকে আল্লাহ
তাঁকে নবী করেছেন তখন
থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি চালা আটা
দেখেননি। জিজ্ঞেস করা হলো, 'আটা
না চেলে আপনারা কিভাবে
খেতেন?' তিনি বললেন, 'আমরা
যব পিষে নিতাম এবং
আটাকে ফুঁ দিয়ে নিতাম।
কিছু ভুষি উড়ে যেতো
আর বাকী অংশের রুটি
তৈরী করতাম ও খেতাম।” (বোখারী)
- ব্যাখ্যা: এখন প্রশ্ন হলো, তিনি ময়দার আটা কেন দেখেননি? চালা আটার রুটি কেন খাননি? তা কি তিনি কোথাও পেতেন না? আসল কথা হলো, তিনি সব কিছুই সংগ্রহ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা পছন্দ করেননি। এর কারণ হলো, উম্মতকে তিনি সাদাসিধে জীবন-যাপন করার শিক্ষা দেয়া ও আরামপ্রিয়তা থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এটাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এবং এ জন্যেই তিনি এ রকম করেছিলেন।
- এ কথা বুঝে নেয়া দরকার, যাঁরা আল্লাহর দ্বীনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তাঁদের জীবনযাত্রার মান সাদাসিধেই রাখা দরকার। প্রয়োজনে ক্ষুৎ-পিপাসা এবং অন্যান্য পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিক্রম করতে হবে। দ্বীনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির সময় তো ব্যয় হবে আল্লাহর দ্বীনের কাজে, সেক্ষেত্রে বিলাসিতার প্রতি আসক্ত হওয়ার মত তার সময় ও সুযোগ কোথায়?
পোস্ট ট্যাগঃ