উম্মতের প্রতি রাসূলের ভালোবাসা
উম্মতের প্রতি রাসূলের ভালোবাসা
প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনে সিরীন রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে আরাফাতে উপস্থিত ছিলাম। দুপুরের পর তিনি মসজিদে নামেরায় যান, আমিও তাঁর সঙ্গে যাই।
পরে ইমাম সাহেব এলে তিনি ইমাম সাহেবের সাথে একসঙ্গে যোহরের ও আসরের নামায পড়েন। তারপর আমরা সকলে আরাফাতে অবস্থান করতে থাকি। যখন আমীরে হজ্জ্ব মুযদালফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন আমরাও তাঁর সঙ্গে রাওয়ানা হই। রাস্তায় আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এক সংকীর্ণ গিরি-পথের কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর উটনীকে বসিয়ে দেন এবং আমরাও আমাদের উটকে বসিয়ে দেই। আমাদের মনে হলো, তিনি সেখানে নামায পড়তে চান।
তাঁর গোলাম,
যে তাঁর উটনীর লাগাম
ধরে ছিল, বলল, 'এখানে
নামায পড়ার তাঁর ইচ্ছা নেই।
বরং তাঁর এ কথা
স্মরণ হয়েছে যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জ্ব যাত্রার সময় এখানে এসে
উটনীকে থামিয়ে দিয়ে প্রসাব-পায়খানায় গিয়েছিলেন। এ কথা মনে
হওয়ায় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসার টানে ইবনে ওমর
রাদিয়াল্লাহু আনহু এখানে থেমেছেন।”
(মুসনাদে আহমদ, তারগীব)
রাসূলের প্রতি
ভালবাসার
আরো
একটি
নিদর্শন
হযরত
উরওয়া বিন আবদুল্লাহ বিন
কুশায়ের বর্ণনা করেছেন, “মুয়াবিয়া ইবনে কুরাহ রাদিয়াল্লাহু
আনহু পিতার বর্ণনার উল্লেখ করে আমাকে বলেছেন,
'তাঁর পিতা বলেন, 'আমি
মুযায়না গোত্রের এক দল লোকের
সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হই
এবং আমরা তাঁর ওপর
ঈমান
আনি। সেই সময় হুজুর
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামার বোতাম খোলা ছিল। আমি
আমার হাত নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নবুয়াতের মোহরকে স্পর্শ করি।'
এই
হাদীসের বর্ণনাকারী উরওয়া রাদিয়াল্লাহু বলেছেন, 'এই কারণে আমি
মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু এবং তার ছেলেকে
সর্বদা জামার বোতাম খোলা অবস্থায় দেখতে
পাই, শরতের সময়ও গরমের সময়ও।” (ইবনে মাজাহ ও
ইবনে হাব্বান তারগীব)
- ব্যাখ্যা: সাহাবাগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসৃত পদ্ধতিকে কেমন দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করতেন এই হাদীসে সে কথা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁরা তর্ক বিজ্ঞান ও দর্শন কি বলে তা বিচার না করে শুধু এটাই দেখতেন যে, তাঁদের প্রিয়তম নেতা কি করেছেন।
বন্দীদের সঙ্গে
ভাল
ব্যবহার
করার
রীতি
হযরত
মুস'আব ইবনে উমায়ের
রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভাই আযীয বিন
উমায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,
“বদরের যুদ্ধে আমিও মুসলমানদের হাতে
বন্দী হয়েছিলাম। নবী করীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্দীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার
হেদায়েত দান করেছিলেন। আমি
আনসারদের কিছু লোকের সঙ্গে
ছিলাম। তাদের অবস্থা ছিল এই যে,
যখন দুপুর ও রাতের খাবার
আনা হতো তখন তারা
নিজেরা খেজুর খেতো আর আমাকে
রুটি খাওয়াতো। কারণ নবী করীম
সা. তাদেরকে বন্দীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার
নসীহত করেছিলেন।” (তাবারানী)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি
ওয়াসাল্লামের
আনুগত্য
হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “মক্কা বিজয়ের বছরে রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার পথে রওয়ানা হন এবং কুরাউল গুমায়ের নামক স্থানে উপস্থিত হন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুজাহিদগণ রোযা রেখেছিলেন। যখন তারা উক্ত স্থানে
উপস্থিত হন তখন হুজুর
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পেয়ালা পানি
আনতে বলেন। তারপর তিনি সেটাকে উঁচু
করেন যেন সমস্ত লোক
তা দেখতে পায়। তারপর তিনি ঐ পানি
পান করেন (রোযা ভেঙ্গে ফেলেন।
কারন তিনি মুসাফির ছিলেন
ও সামনে জিহাদের অভিযান ছিল)। পরে
তাঁকে জানানো হয় যে, কিছু
কিছু লোক রোযা রেখেছিলেন,
ভাঙেননি। তখন তিনি বললেন,
'এ সব লোক হলো
নাফরমান (আনুগত্য অমান্যকারী)। (মুসলিম)
- ব্যাখ্যা: এই হাদীস থেকে এ কথাও পরিষ্কার হলো যে আসল জিনিস হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা। সুন্নাত থেকে বিচ্যুত হয়ে কেউ যতই ইবাদত করুন না কেন তার কোন গুরুত্ব আল্লাহর কাছে নেই।
নেতার আদেশ
পালনের
অপূর্ব
দৃষ্টান্ত
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ খবর জানতে পারেন যে, নতুন অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আবু সুফিয়ানের সৈন্যদল সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে রওনা হয়েছে তখন তিনি সাহাবাগণের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
সা'আদ ইবনে
উবাদা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
'হে আল্লাহর রাসূল! যাঁর হাতে আমার
জীবন তাঁর কসম। যদি
আপনি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশ করেন তাহলে
আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো, আর আপনি যদি
শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বারকুল
গুমাদ পর্যন্ত যেতে আদেশ করেন,
তাহলে হাসিমুখেই আমরা সে পর্যন্ত
চলে যাবো।” (মুসলিম)
সাহাবাদের ঈমানী
দৃঢ়তার
নমুনা
হযরত তারিক বিন শিহাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এ কথা বলতে শুনেছি, 'আমি মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এমন একটি কাজ দেখেছি, তা যদি আমার দ্বারা সম্পন্ন হতো! কারণ সে কাজটি ছিল আমার কাছে সব কাজ থেকে অধিক প্রিয়! যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার
জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, সেই সময় মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, 'মুসা আলাইহিস সালামের জাতি যেমন তাঁকে বলেছিল, 'হে মূসা, যাও তুমি ও তোমার প্রভু যুদ্ধ করো' আমরা আপনাকে সে রকম বলবো না। বরং আমরা আপনার ডান দিক দিয়ে যুদ্ধ করবো, বাম দিক দিয়ে যুদ্ধ করবো, আপনার সামনে যুদ্ধ
করবো এবং আপনার
পেছনে থেকেও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবো।' যখন মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু
এ কথা বলেন, তখন
আমি দেখি, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখমন্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।” (মুসনাদ
আহমদ)
- ব্যাখ্যা: এ হাদীসে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তা বদর যুদ্ধের ঘটনা। পূর্বেই তিনি খবর পেয়েছিলেন, আবু সুফিয়ানের কাফেলা নুতন অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ ও খাদ্য সম্ভার নিয়ে সিরিয়া থেকে রওনা হয়েছে। তিনি সেই দলের প্রতিরোধের ব্যাপারে যখন পরামর্শ করছিলেন এমন সময় হঠাৎ খবর
- পান যে, মক্কার মুশরিকদের এক হাজার সৈন্য ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্যে যাত্রা শুরু করেছে। মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু সেই সংকটময় মূহুর্তে এ কথা বলেছিলেন। এর অর্থ হলো, আমরা পলায়ন করার মত লোক নই। আমরা আপনার প্রতিটি আদেশ পালন এবং সব রকমের ত্যাগ স্বীকারের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবো। প্রয়োজনে আমাদের জীবন বিলিয়ে দেবো, কিন্তু আপনার নির্দেশের অন্যথা হতে দেবো না।
দ্বীনী জলসায়
অংশ
গ্রহণের
আহ্বান
হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন সাহাবীর সঙ্গে মিলিত হতেন তখন বলতেন, 'এসো কিছুক্ষণের জন্য আমরা আমাদের প্রভুর ওপর ঈমান আনি।' একদিন তিনি কোন এক ব্যক্তিকে এ কথা বললে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হন এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে
অভিযোগ করেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল। ইবনে রাওয়াহাকে দেখুন। তিনি মানুষকে সারা জীবন ঈমান রাখার পরিবর্তে কিছুক্ষণের জন্য ঈমান আনার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।' নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আল্লাহ ইবনে রাওয়াহার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। সে তোমাদেরকে দ্বীনী জলসা বা অনুষ্ঠানের জন্য দাওয়াত দান করছিল। সে ওই সব দ্বীনী সভাকে ভালবাসে, যার জন্যে ফেরেশতাগণও গর্ব বোধ করে থাকেন।” (মুসনাদে আহমদ)
- ব্যাখ্যা: আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা যে কথা বলেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল, 'আসুন, কিছুক্ষণের জন্যে আমরা আল্লাহর যিকির ও আলোচনার মাধ্যমে আমাদের ঈমানকে সমৃদ্ধ করে তুলি। তাঁর অনুগ্রহকে স্মরণ করি, দ্বীনি জ্ঞানকে বৃদ্ধি করি, তাঁর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে উপলব্ধি করি। কিন্তু সেই ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিযোগ
- করেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে রাওয়াহার উদ্দেশ্য কি তা তাঁকে বুঝিয়ে বলেন। এখানে আরেকটি বিষয় চিন্তা করা দরকার। সেই ব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে বলেছিলেন, হুজুর, আপনার ঈমানের দাওয়াততো সব সময়ের জন্যে,
- জীবনব্যাপী মুমিন হয়ে থাকার দাওয়াত। কিন্তু ইনি কিছুক্ষণের জন্যে ঈমানের দাওয়াত দিচ্ছেন। ইনি তো এক মতুন দাওয়াত দিচ্ছেন! অর্থাৎ সেই সময়ের সকল মুসলমানই জানতেন, নবীর দাওয়াত সর্বক্ষণের দাওয়াত, সমগ্র জীবনের জন্য দাওয়াত। এ দ্বীনকে তাঁরা এমনভাবে ভালবাসতেন যে, জীবনের প্রতিটি স্তরে তাকে বাস্তবায়নের জন্য তাঁরা সব সময় উদগ্রীব থাকতেন।
পোস্ট ট্যাগঃ
রাসূলের প্রতি ভালবাসার একটি নিদর্শন
রাসূলের প্রতি ভালোবাসা
রাসূলের ভালোবাসা
নবীর প্রতি ভালোবাসা
রাসূলের প্রতি সাহাবীদের ভালোবাসা
রাসূল সাঃ এর প্রতি ভালোবাসা
রাসুলের প্রতি ভালোবাসা