সাহাবীদের ঘটনা
সাহাবীদের ঘটনা
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু বর্ণনা করেছেন, “যদি কেউ কারো
অনুকরণ করতে চায় তাহলে
যারা মারা গেছেন তাঁদের
অনুকরণ করা উচিত। কারণ
মানুষ যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ ফেতনায়
পড়ার এবং দ্বীনে হক
থেকে বিচ্যুত হবার আশঙ্কা থাকে।
যাঁদের অনুকরণ করতে হবে তাঁরা হলেন আসহাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁরা এই উম্মতের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের অন্তরে আল্লাহতায়ালার আনুগত্য ছিল, ছিল দ্বীনের গভীর জ্ঞান। তাঁরা লৌকিকতা ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে দূরে থাকতেন। আল্লাহ তাঁদেরকে আপন নবীর সাহায্য
করার জন্যে ও আপন দ্বীন
প্রতিষ্ঠা করার জন্যে নির্বাচিত
করে নিয়েছিলেন। সুতরাং, হে মুসলমানগণ! তোমরা
তাঁদের মর্যাদা জেনে নাও। তাদের
অনুসরণ করো এবং যথাসাধ্য
তাদের নীতি-নৈতিকতা ও
চরিত্রকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করো। কারণ তাঁরা
সোজা রাস্তায় ছিলেন, আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথে ছিলেন।”
(মিশকাতুল মাসাবীহ)
- ব্যাখ্যা: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিকাংশ সংগী-সাথী পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তিনি দেখেন, নবুয়তের যুগ যত দূরে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে ততই খারাবী সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন দল
- বিভিন্ন মানুষকে আপন পথ-প্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করছে। সে জন্য তিনি উপদেশ দেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী-সাথীদের অনুসরণ করো। তাদেরকে অগ্রণী ও পথ-প্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করো এবং তাদের চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতার অনুসরণ করো।
সকল কাজ
আল্লাহর
সন্তুষ্টির
জন্য
করার
ফজিলত
আবু
ইদরিস খাওলানী বর্ণনা করেছেন, “একদা আমি দামেশকের
জামে মসজিদে যাই। সেখানে আমি
এক ব্যক্তিকে দেখতে পাই, যার দাঁত
খুব চকচকে ও সাদা ছিল।
তার চতুর্দিকে অনেক লোক বসেছিল।
তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। যখন তাদের মধ্যে
মতানৈক্য দেখা দিত তখন
তারা উল্লেখিত ব্যক্তির মত জানতে চাইতো।
তিনি যে মত দিতেন
সবাই তা মেনে নিত।
আমি জিজ্ঞেস করি, 'ইনি কে?' জবাবে
বলা হলো, “ইনি হচ্ছেন মুয়াজ
ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু।'
পরদিন আমি জোহরের নামাযের জন্য একটু তাড়াতাড়িই মসজিদে যাই। দেখি, মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন এবং নামায পড়ছেন। আমি তাঁর সাথে কথা
বলার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তিনি নামায শেষ করলে আমি তাঁর কাছে যাই এবং সালাম দেই। তারপর বলি, 'আল্লাহর কসম, আমি আল্লাহর জন্যেই আপনাকে ভালবাসি।' তিনি জিজ্ঞেস করেন, 'আল্লাহর জন্যে?' আমি বলি, 'হ্যাঁ, আল্লাহর জন্যে।' তখন তিনি আমার চাদর ধরে নিজের দিকে টানেন
এবং বলেন, 'তোমার
জন্যে আনন্দ সংবাদ! আমি নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি আল্লাহ
বলেন, 'যারা আমার জন্যে
কাউকে ভালবাসে, এবং আমার জন্যই
এক সঙ্গে মিলিত হয় আর কেবল
আমার জন্যই একে অপরের জন্যে
খরচ করে, আমি অবশ্যই
তাদের ভালবাসি।” (তারগীব ও তারহীব, মুয়াত্তা)
মনে খারাপ
চিন্তা
উদয়
হওয়া
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.
বর্ণনা করেছেন, “এক ব্যক্তি নবী
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে
বলে, 'হে রাসূলুল্লাহ সা.
আমার মনে এত মন্দ
চিন্তা হয় যে, মনে
হয় তা উচ্চারণ করার
আগে জ্বলে কয়লা হয়ে যাওয়াই আমার
পক্ষে উত্তম।' তিনি বললেন, 'সমস্ত
প্রশংসা আল্লাহর, যিনি মুমিনের এ
ধরনের মন্দ চিন্তাকে অসঅসাতে
পরিবর্তন করে দিয়েছেন।” (আবু
দাউদ)
- ব্যাখ্যা: সেই ব্যক্তির মনে ঈমান ও ইসলামের পরিপন্থী চিন্তা জন্ম লাভ করছিল। সে জন্য তিনি অস্বস্তি বোধ করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হন। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সান্তনা দেন এবং বলেন, ঘাবড়াবার ও অস্বস্তি বোধ করার কোন কারণ নেই।
- মুমিনের ঈমানের ওপর ডাকাতি করার জন্য শয়তান এ ধরনের অসঅসা সৃষ্টি করে। শয়তান তো নিজের কাজ অবশ্যই করবে, আর মুমিনের কাজ হলো, যখন এ ধরনের চিন্তা মনে দেখা দেবে তখন সে যেন তা মন থেকে দূর করার চেষ্টা করে। এ ধরনের চিন্তার উদয় হবার কথা নয়, তা তো আসবেই। কিন্তু মন্দ চিন্তার জন্যে মন ও মস্তিষ্কের দরজা খোলা রাখা এবং মনের মধ্যে তা লালন করাই হলো খারাপ।
খারাপকে খারাপ
জানাই
বিশুদ্ধ
ঈমানের
প্রমাণ
হযরত
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন,
“নবী করীম সা. এর
কাছে তাঁর কিছু সাহাবা
উপস্থিত হন এবং তাঁরা
বলেন, 'কখনো কখনো আমাদের
মনে এমন খারাপ চিন্তার
উদয় হয় যা আমরা
মুখে প্রকাশ করতে পারি না।'
তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আসলেই কি তোমাদের মনে
এ ধরনের চিন্তা উদয় হয়। তাঁরা
বলেন, 'হ্যাঁ।' তখন তিনি বললেন,
'এ তোমাদের বিশুদ্ধ ঈমানের প্রমাণ।' (মুসলিম)
- ব্যাখ্যা: অর্থাৎ তোমাদের মনে খারাপ চিন্তার উদয় হওয়ার অর্থ হলো, তোমাদের কাছে ঈমানের পুঁজি আছে। শয়তান এ ধরনের অসঅসা সৃষ্টি করে ঐ পুঁজিকে লুট করতে চায়। তাই এতে অস্বস্তি বোধ করার
- কোন কারণ নেই। তোমাদের নিজেদেরকে কাজ করতে হবে, শয়তানও নিজের কাজ করবে। তোমরা সর্বদা শয়তানের অসঅসার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাও, এটাই তোমাদের জন্যে যথেষ্ট। আর তোমরা যে খারাপকে খারাপ বলে সনাক্ত করতে পারছো এতেই প্রমাণিত হয় তোমাদের ঈমান সজীব আছে।
আল্লাহর হুকুম
সব
সময়ই
সহজ
সরল
হযরত উমাইমা বিনতে রুকাইকা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন, কিছু মহিলার সঙ্গে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীন ও দ্বীনি আহকাম অনুযায়ী ‘আমল' করার প্রতিজ্ঞা করি।আমাদের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নেবার সময় তিনি বললেন, 'যতোটা তোমাদের সাধ্যে মধ্যে হয় ও যতোটা তোমাদের দ্বারা সম্ভব।' আমি বলি, 'আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের ওপর আমাদের নিজেদের অপেক্ষাও অধিক দয়াশীল।” (মেশকাত)
- ব্যাখ্যা: হযরত উমাইমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমার বর্ণনার অর্থ হলো, আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিজেদের অপেক্ষা আমাদের অধিক মঙ্গলকামী ও আমাদের ওপর দয়াশীল। তাঁদের তরফ থেকে আসা হেদায়াত কখনো আমাদের সামর্থ ও শক্তির বাইরে হতেই পারে না। সুতরাং এই শর্ত আরোপের কোন বিশেষ প্রয়োজন নেই। এই হলো সাহাবায়ে কিরামের চিন্তা ভাবনার ধরন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু কতই না সত্যি কথা বলেছেন!
মোনাফেকী কি?
হযরত
মুহাম্মদ ইবনে যায়েদ বর্ণনা
করেছেন, “কিছু লোক আমার
দাদা আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের কাছে
আসেন। তারা বলেন, 'আমরা
শাসকের দরবারে যা বলি সেখান
থেকে বেরিয়েই অন্য রকম বলি,
এ কেমন কথা?' হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.
জবাব দেন, 'আমরা নবী করীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এটাকে মোনাফেকী
কাজ বলতাম।” (তারগীব ও তারহীব, বোখারী)
- ব্যাখ্যা: এখানে শাসক বলতে বনু উমাইয়া বংশের শাসকদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ইয়াজিদের শাসনকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। উমাইয়া শাসকগণ পুরোপুরি খেলাফতে রাশেদার রূপরেখা অনুসরণ করতেন না। তাঁরা তাতে অনেক বিচ্যুতি ঘটিয়ে ছিলেন।
সাহাবায়ে কিরামের আনন্দ বিনোদন
হযরত কাতাদা (তাবেঈন) বর্ণনা করেছেন, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. কে জিজ্ঞেস করা হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ কি হাসতেন?' তিনি জবাব দেন, 'হ্যাঁ, তাঁরা
হাসতেন এবং তাঁদের অন্তরে
ঈমান ছিল পাহাড়ের ন্যায়
দৃঢ়মূল।' হযরত বিলাল ইবনে
সায়াদ বলেছেন, 'আমি সাহাবাগণকে দিনে
দৌড় প্রতিযোগিতা করতে দেখেছি এবং
তাদেরকে পরস্পরের মধ্যে হাসতেও দেখেছি। কিন্তু যখন রাত হয়ে
যেতো তখন তাঁরা রাহেব
হয়ে যেতেন।” (মেশকাত)
- ব্যাখ্যা: সাধারণভাবে এ কথা মনে করে নেয়া হয় যে, আল্লাহকে যাঁরা ভয় করেন তাঁদের হাসা উচিত নয় এবং দৌড় প্রতিযোগিতা বা এ ধরনের কোন কাজ করা উচিত নয়। কারণ এ সব কিছুকে দুনিয়ার কাজ মনে করা হয়। এ জন্যে প্রশ্নকারী এ কথা জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেছেন, হাসা ও দৌড় প্রতিযোগিতা
- করা এবং তীর ও বর্শা চালানো অভ্যাস করা দুনিয়াদারী নয়, বরং এ সব হলো দ্বীনের কাজ। সুতরাং সাহাবাগণ দিনে এ সব কাজ করতেন। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তাঁরা কেবল আপন আল্লাহর কাছে দোয়া ও মোনাজাত করতেন এবং নফল নামায ও কোরআন পাঠে নিযুক্ত থাকতেন। দিনের ঘোড়সওয়ার ও গাজী রাতে দরবেশ হয়ে যেতেন।
বিনোদনের শ্রেষ্ঠ
মাধ্যম
কাব্য
চর্চা
করা
হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সংকীর্ণমনা ও ক্ষুদ্র মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন না। তারা নিজেদেরকে ক্ষুদ্রগণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে মরার মত নিশ্চল জীবন যাপন করতেন না। তাঁরা দল বেঁধে কবিতার
আসর বসাতেন এবং নিজেরা কবিতা
আবৃত্তি করতেন ও শোনাতেন। জাহেলীজীবনের দুঃখ ও তার
ইতিহাস বর্ণনা করতেন। কিন্তু যখন আল্লাহর দ্বীনের
ব্যাপারে তাদের কাছে কোন অশোভনীয়
প্রস্তাব রাখা হতো তখন
রাগে তাঁদের চোখের তারা নাচতে থাকতো।
এমনভাবে নাচতো, যেন তারা পাগল
হয়ে গেছেন।” (আল-আদাবুল মুফরাদ)
- ব্যাখ্যা: সাহাবাগণ অন্যান্য ধর্মের নেতাদের মত নিজেদেরকে এমনভাবে আলাদা করে রাখতেন না যে, তারা কারো সঙ্গে কথা বলতেন না, কারো কাছে বসতেন না এবং সর্বদা মোরাকাবায় পড়ে থাকতেন। বরং সাহাবাগণ অতিশয় খোলা মনের লোক ছিলেন। সকলের সঙ্গে মেলামেশা করতেন এবং এক কোণে
- মাথা নিচু করে বসে থাকতেন না। যখন সুযোগ হতো কাব্যসভা করতেন। নিজেরা কবিতা শোনতেন ও শোনাতেন। জাহেলিয়াতের সময়কার নিয়ম-কানুনের অসারতা এবং খারাবী তুলে ধরে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতেন। দ্বীনকে তাঁরা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন ও ভালবাসতেন। দ্বীনের ব্যাপারে রাসূলের সুন্নাহ বিরোধী কোন কথা বললে তাঁরা রাগে লাল হয়ে যেতেন। তাঁরা এতটাই ক্ষিপ্ত হতেন যে, তাঁদের চোখের তারা নাচতে থাকতো, মনে হতো যেন তাঁরা পাগল হয়ে গেছেন।
পোস্ট ট্যাগঃ