পুলসিরাত কাকে বলে
পুলসিরাত কাকে বলে
ফারসি শব্দ ’পুল’ এর মানে
সেতু ও আরবি শব্দ ’সিরাত’
এর অর্থ হলো পথ বা রাস্তা। দোযখের ওপরে আল্লাহপাক পুলসিরাত তৈরি করবেন এবং প্রত্যেক
ব্যক্তিকে তার উপর দিয়ে যেতে বলবেন। যেই ব্যক্তি ঈমানদার হবে সে চোখের পলকে পুলসিরাত
পার হবেন। আর যিনি গুনাহগারী হবেন তিনি পার হতে গিয়ে অনবরত পুল সিরাতের ওপর থেকে পড়ে
ভয়াবহ আযাবে পতিত হবেন। মহান আল্লাহপাক আমাদের সকলকে চোখের পলকে পুলসিরাত পার হওয়ার
তৈফিক দান করুন আমিন।
আবু
আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন, “আমি রাধাযা নামক
স্থানে হযরত আবু যার
গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকটে উপস্থিত হই। সে সময়
তাঁর কাছে এক কৃষ্ণকায়
কদাকার মহিলা বসেছিল, না তার কোন
রূপ ছিল আর না
সে কোন সুগন্ধি মেখেছিল।
হযরত আবু যার গিফারী বললেন, 'তোমরা কি দেখেছো না এ মহিলা আমাকে কি পরামর্শ দিচ্ছে। এ আমাকে ইরাক যেতে বলছে। আমি যদি ইরাক যাই তাহলে লোকেরা আমাকে মাল-পত্র দেবার জন্যে সেখানে হিড়িক লাগিয়ে দেবে।
অথচ আমার প্রিয়
নবী আমাকে এ নসীহত করেছেন
যে, জাহান্নামের পোলের উপর এক অতি
পিচ্ছিল রাস্তা আছে, যার উপর
দিয়ে আমাদের যেতে হবে। তাই
আমাদের কাছে যত কম
মালপত্র থাকবে সে রাস্তা পেরোনো
আমাদের জন্য ততই সহজ
হবে। মালপত্রের বোঝা বেশী হলে
সেদিন মুক্তির সম্ভাবনা থাকবে কম।” (তারগীব ও তারহীব, আহমদ)
দ্বীনের জন্য
অবর্ণনীয়
দুঃখ
কষ্টের
পুরস্কার
ফাজালা
ইবনে উবায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নামায পড়াতেন
তখন আসহাবে সুফ্ফার লোকেরা ক্ষুধার চোটে পড়ে যেতো।
এমন কি গ্রাম থেকে
আগত মানুষ, যারা এদের অবস্থা
সম্পর্কে কিছু জানতো না,
তারা মনে করতো, এরা
পাগল হবে।
যখন
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম নামায পড়া শেষ করে
তাদের দিকে ফিরে বলতেন,
‘হে সুফাবাসীগণ, তোমরা যদি এ কোরবানীর
যে পুরস্কার আখেরাতে পাবে তা জানতে
পারতে, তাহলে তোমরা আরো অধিক থেকে
অধিক অনাহার ও উপবাস করার
আকাঙ্খা করতে।” (তারগীব ও তারহীব, তিরমিযী)
আসহাবে সুফ্ফা
- ব্যাখ্যা: আসহাবে সুফ্ফা বলতে বুঝানো হয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলাম কবুল করার অপরাধে আপন আপন ঘর থেকে নিঃস্ব অবস্থায় বহিষ্কৃত হয়ে নবীজীর কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাদের সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়, তাঁরা কুঁড়ে ও অলস ধরনের লোক ছিলেন। তারা অন্যেরটা খেয়ে মানুষ হবার মত লোক ছিলেন না।
- তারা নিজেদের জীবিকা নিজেরা উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের কাজের জন্য তাদের সমস্ত সময় নিয়ে নিয়েছিলেন। তারা দ্বীনের চর্চা ও জ্ঞান সাধনায় সময় অতিবাহিত করতেন। তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতেন।
- তাদেরকে বিভিন্ন বাহিনীর সাথে মোবাল্লিগ হিসাবে পাঠানো হত। মোটকথা, দ্বীনের কাজেই তাঁরা সমস্ত সময় ব্যস্ত থাকতেন। ফলে তাঁরা আয় রোজগার ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার সময় পাবেন কেমন করে? তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সম্মিলিতভাবে মুসলমানরা পালনের যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও সেটা ছিল পরীক্ষার যুগ। সমগ্র মুসলিম সমাজই যেখানে ক্ষুৎ-পিপাসার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিল সেখানে তাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা করার সুযোগ কোথায়?
গরীবরা ধনীদের
চেয়ে
চল্লিশ
বছর
আগে
বেহেশতে
যাবে
হযরত
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু
আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি মসজিদে নববীতে
বসে ছিলাম। মসজিদে গরীব মুহাজিরদের একটি
দলও বসেছিল। এমন সময় নবী
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন কামরা থেকে
বের হয়ে মসজিদে আসেন
এবং গরীব মুহাজিরদের মধ্যে
গিয়ে বসেন। তখন আমিও উঠে
সেখানে চলে যাই।
নবী
করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজিরদের উদ্দেশ্য করে বলেন, 'গরীব
মুহাজিরদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। তাদের বিমর্ষতা আনন্দে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া উচিত।
কারণ তারা বিত্তশালীদের চেয়ে
চল্লিশ বছর আগে জান্নাতে
প্রবেশ করবে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর বলেন,
‘গরীব মুহাজিরদের মুখ তখন সত্যি
আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আমার
মনেও এই আকাঙ্খা জন্মায়,
হায়! আমি যদি এই
গরীব মুহাজিরদের একজন হতাম!” (মিশকাত)
- ব্যাখ্যা: এসব লোক দ্বীনের পথে নিজেদের সবকিছু লুটিয়ে দিয়ে ঘর-দোর ছেড়ে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এ জন্য ইসলামের ইতিহাসে এঁদের স্থান অনেক উর্ধ্বে। আর এঁদের মধ্যে যে যত বেশী কোরবানী দিয়েছেন তাঁর স্থান তত বেশী উর্ধ্বে- এ দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও।
- এখানে চিন্তার বিষয় হলো, যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের আনন্দ সংবাদ শুনিয়েছিলেন তখন তাঁদের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল কেন? আমরাও এ সব শুনি এবং পড়ি, কিন্তু আমাদের এ অবস্থা হয় না কেন?
- এর কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের আকাঙ্খা এত তীব্র ছিল, যা আমাদের মধ্যে নেই। নিরবচ্ছিন্ন পরীক্ষা তাদের জান্নাতের পিপাসা আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছিল। ব্যবসায়ী যে দোকানে যত বেশী মূলধন লাগায় এবং তার উন্নতির জন্য যত বেশী পরিশ্রম করে সে দোকানের প্রতি তার আগ্রহ ও ভালবাসাও তত বেশী হয়ে থাকে।
নামায জান্নাতের
পথ
প্রশস্ত
করে
হযরত রাবী'য়া ইবনে কা'আব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, 'আমি সমস্ত দিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেবা করতাম আর যখন রাত হতো তখনও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত থাকতাম এবং সেখানে রাত কাটাতাম।
আমি
তাঁর মুখ থেকে সব
সময় শুনতাম, 'সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ সুবাহানা
রাব্বী।
এমনকি আমি তা শুনতে
শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, আর
আমার চোখ ঘুমে জড়িয়ে
আসতো এবং আমি ঘুমিয়ে
পড়তাম।
একদিন
তিনি বললেন, 'হে রাবী'য়া,
তুমি আমার কাছে চাও
আমি তোমাকে দেবো।'
আমি বলি, 'আমাকে কিছু সময় দিন, আমি চিন্তা করে দেখি আমার কি চাওয়া উচিত।' তারপর আমার মনে হয়, এ দুনিয়া তো নশ্বর, এতো ধ্বংস হয়ে যাবে। এর সম্পর্কে কি চাইবো? তাই আমি বলি, 'হে রাসূলুল্লাহ! আমার প্রার্থনা হলো,
আপনি আমার
জন্যে এ দোয়া করুন,
আল্লাহ যেন আমাকে জাহান্নামের
আগুন থেকে বাঁচান এবং
জান্নাতে প্রবেশ করান।' আমার কথা শুনে
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
তারপর বললেন, তোমাকে এ কথা কে
শিখিয়ে দিয়েছে?'
আমি বলি, এ কথা আমাকে কেউ বলে দেয়নি। বরং আমার মনে হয়েছে, এ দুনিয়া তো নশ্বর এবং এ তো ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই এরকম জিনিস আমি কেন চাইবো? আর আমি জানি, আপনি হচ্ছেন আল্লাহর সব থেকে প্রিয় পাত্র।
এ জন্য আমি এটাই
পছন্দ করেছি যে, আমি আখেরাতের
পরিত্রাণের বিষয়টি আপনার সামনে তুলে ধরি এবং
আপনি আমার জন্য দোয়া
করুন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'আমি অবশ্যই তোমার
জন্য দোয়া করবো। তবে তুমি বেশী
বেশী নামায পড়ে আমাকে সাহায্য
করো।” (তারগীব ও তাবরানী)
- ব্যাখ্যা: সে সব পবিত্র মানুষ, যাদের আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবা বলি, তারা খুব বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী লোক ছিলেন। তাঁরা জানতেন, যে জিনিস নশ্বর তার জন্য দোয়া করা বা করানোতে ফায়দা কিছু নেই। আখেরাতের বিষয়ই হলো দোয়ার উপযুক্ত জিনিস।
- আখেরাতের সমস্যাই হচ্ছে আসল সমস্যা- যেখানে আল্লাহর ক্রোধের আগুন থেকে বেঁচে চিরস্থায়ী শান্তির ঘরে স্থান লাভ করতে পারাই মুল কথা। এ বিষয়ে নবীজীর নসিহত হচ্ছে, বেশী বেশী সিজদার মাধ্যমে মানুষের এ আকাঙ্খা পুরণ হতে পারে। তাই আখেরাতের পরিত্রাণ ও মঙ্গল যাদের কাম্য তাদের উচিত নামাযে নিবিষ্ট হওয়া। হক আদায় করে ফরয নামায পড়া এবং বেশী করে নফল নামায পড়া।
রোযা হচ্ছে
তুলনাবিহীন
ইবাদত
হযরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বলি, ‘হে রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন কাজ বলে দিন যাতে আমি জান্নাত লাভ করতে পারি।' তিনি বললেন, 'তুমি অতি অবশ্যই রোযা রাখবে।
কারণ
রোযা হচ্ছে এক তুলনাবিহীন ইবাদত।'
আবু উমামার ছাত্র বর্ণনা করেছেন, ‘এরপর আবু উমামার
অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল
যে, অতিথি আসার সময় ছাড়া
দিনের বেলা তাঁর ঘর
থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়নি।” (তারগীব)
আল্লামা জলীল আহসান নদভী
পোস্ট ট্যাগঃ