কিয়ামতের আলামত সমূহ
কিয়ামতের আলামত সমূহ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'তোমরা আমার কাছে দ্বীন সম্পর্কে প্রশ্ন করো।কিন্তু তাঁর প্রতি আদব ও সম্মানের জন্যে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইতো না (প্রত্যেকের মধ্যেই এমন আকাঙ্খা বিরাজ করতো, অন্য কেউ এসে প্রশ্ন করুক যাতে আমরা সবাই লাভবান হতে পারি।)
এ সময় এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রাসূলের কাছে বসে জানতে চাইলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইসলাম কি?' তিনি বললেন, 'আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক না করা, নামাজ কায়েম করা, আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করা এবং রমযানের রোযা রাখা।'
এ জবাব শুনে আগন্তুক বলে উঠলেন, 'আপনি ঠিক বলেছেন।' তারপর তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল, ঈমান কি?' রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আল্লাহকে মানা, তাঁর ফেরেশতাদের মানা, তাঁর কিতাবকে মানা, তাঁর রাসূলদের মানা, মরার পর পূনরায় জীবিত হওয়ার কথা বিশ্বাস করা এবং এটা বিশ্বাস করা যে, এ দুনিয়ায় যা কিছু হয় সবই আল্লাহর কুদরতে হয়।'
লোকটি বললেন, 'আপনি ঠিক বলেছেন।' তিনি পূনরায় জিজ্ঞেস করলেন, 'হে রাসূলুল্লাহ, ইহসান কি?' নবীজি বললেন, “ইহসান হলো, তুমি এমনভাবে আল্লাহকে ভয় করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। কারণ যদিও তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছো না, কিন্তু তিনি ঠিকই তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।' লোকটি এবারও বললেন, 'আপনি সঠিক কথাই বলেছেন।'
কিয়ামতের আলামত
হযরত আবু শুরাইহ্ খুযায়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, 'আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তোমরা কি এর সাক্ষ্য প্রদান করো না?
জবাবে সবাই বললাম, 'হ্যাঁ, আমরা এ দু'টি কথারই সাক্ষ্য দান করি।'
এরপর তিনি বললেন এ কুরআনের একটি প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অন্য প্রান্তটি তোমাদের হাতে। তাই তোমরা কোরআনকে শক্ত করে ধরে রাখো, তাহলে তোমরা কখনো সরল সোজা পথ থেকে বিভ্রান্ত হবে না এবং ধ্বংসের মধ্যে নিমজ্জিত হবে না। (তারগীব ও তাহরীব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়ত
- ব্যাখ্যাঃ ঈমানের আভিধানিক অর্থ হলো বিশ্বাস করা এবং আস্থা স্থাপন করা। আর ইসলামের অর্থ হলো নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পন করা। ইহসানের অর্থ হলো কোন কাজ আগ্রহ সহকারে এবং যথাযথভাবে করা। তৃতীয় প্রশ্নের উদ্দেশ্য হলো, কোন ব্যক্তি আল্লাহর উৎকৃষ্ট ও মোত্তাকী বান্দা কেমনভাবে হতে পারে তা জানা।
- এর উত্তরে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নেক আমল ও নেক নিয়ত কেবলমাত্র সেই অবস্থায় হতে পারে, যখন মানুষের মনে সর্বদা এ ধারনা জাগ্রত থাকে যে, সে আল্লাহকে দেখছে, আল্লাহর সামনে হাজির আছে। অথবা এ কথা মনে করা যে, আল্লাহ তো আমাকে দেখছেন। মোটকথা, নিজেকে আল্লাহর সামনে হাজির মনে করা বা আল্লাহ যে তাকে দেখছেন এ কথা অন্তর দিয়ে উপলব্ধি না করলে তার মধ্যে খোদভীতি যথার্থভাবে সৃষ্টি হতে পারে না।
কিয়ামতের লক্ষণ
স্ত্রীলোক আপন মালিকের কর্তা হওয়ার অর্থ বলতে আমরা বুঝি, তখন স্ত্রী আর আপন স্বামীর অনুগত থাকবে না। চাকরাণী মালিকের মাথায় এবং পুত্র পিতার মাথায় চড়ে বসবে এবং ছোটরা বড়দের সম্মান করবে না। এটা হলো কিয়ামতের একটা লক্ষণ। দ্বিতীয় লক্ষণ হলো, সভ্যতা ও শালীনতা বিমুখ ব্যক্তিদের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে যাবে।
আর তৃতীয় লক্ষণ হলো, গরীব লোকদের হাতে প্রচুর অর্থসম্পদ চলে আসবে এবং সম্পদের এ প্রাচুর্য উঁচু উঁচু প্রাসাদ তৈরী ও অন্যের অপেক্ষা নিজের অট্টালিকার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজে ব্যয় হবে। যখন এ লক্ষণগুলো দেখা দেবে তখন বুঝতে হবে, কিয়ামত নিকটবর্তী। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, কিয়ামত কখন হবে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
কালেমা শাহাদাত এবং অন্তরের ইখলাস
ইখলাস-এর অর্থ কি?
হযরত যায়েদ বিন আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি ইলাসের সঙ্গে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। ঘোষণা দেবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ‘ইখ্লাস-এর অর্থ কি?' তিনি বললেন, “ইখ্লাসের অর্থ হলো, কালেমা তাইয়েবা পাঠ করার পর সেই ব্যক্তি আল্লাহর হারাম ঘোষিত বস্তু উপভোগ করা থেকে বিরত হয়ে যায়।' (তারগীব ও তারহীব)
মুসনাদে আহমদ-এর এক বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, 'যে ব্যক্তি সাচ্চা মনে এ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই এবং সাক্ষ্য দেয় যে, আমি আল্লাহর রাসূল আর তারপর সোজা রাস্তায় চলে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।'
কালেমা তাওহীদ
“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্ দাহু লা-সারিকা লা-হু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ইউহা ই ওয়া উ মিতু বি ইয়া সি হিল খাইরু ওয়া-হু-ওয়া আ-লা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।”
তিরমিযী শরীফের এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, 'যে ব্যক্তি কালেমা তাওহীদ পাঠ করে এবং বড় বড় গুনাহ থেকে দূরে থাকে সে জান্নাতে যাবে।'
নেক আমলের বরকত
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'হে আল্লাহর রাসূল, ইসলাম কবুল করার আগে আমরা জাহেলিয়াতের মধ্যে যে আমল করেছি তার জন্যে আমাদের পাকড়াও করা হবে কি?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'যেসব লোক ইখলাসের সঙ্গে ইসলাম কবুল করবে তাদের জাহেলিয়াতের মধ্যে কৃত আমলের জন্যে পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু যারা নিষ্ঠার সঙ্গে ইসলাম কবুল করবে না তারা উভয় কালের কৃত গুনাহের জন্য অভিযুক্ত হবে।”
ঈমানের বৈশিষ্ট্য
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সময় মৃত্যু শয্যায় শায়িত এক যুবকের কাছে উপস্থিত হন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি এখন কেমন বোধ করছো?’ যুবকটি জবাব দিল, 'হে আল্লাহর রাসূল, আমি আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী।
আমি নিজের গুনাহের কথা স্মরণ করে ভয় পাচ্ছি।' তিনি বললেন, 'এমন অবস্থায় (অর্থাৎ জীবন বেরিয়ে যাবার সময়) যার মনে এই দুই খেয়াল বিদ্যমান থাকবে আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই তার আকাঙ্খা পূরণ করবেন এবং যা নিয়ে সে ভয় পাচ্ছে তা থেকে তাকে রক্ষা করবেন। (অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাবেন এবং রহমতের ঘরে প্রবেশ করাবেন)।
- ব্যাখ্যাঃ এই হাদীসের শিক্ষা হলো, মুমীন কখনো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না আবার আপন গুনাহের কাজেও বেপরোয়া হয় না। এ কথাকে বুজুর্গ ব্যক্তিগণ এ ভাষায় বর্ণনা করেছেন, 'ঈমান ভয় ও আশার মাঝখানে বিদ্যমান। আল্লাহর রহমতের আশা নেক আমলের দ্বারা জন্মলাভ করে এবং গুনাহের ভয় নাফরমানী থেকে রক্ষা করে। তওবা ও ইস্তেগফার মানুষকে ঈমানের দিকে নিয়ে যায়।
কোরআনের আলোকে মানুষের অধিকার ও কর্তব্য
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভাষণে বলেছেন, 'আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক হকদারের হক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (তাই হক্দারের হক্ আদায় করো)। শোন, আল্লাহ কিছু দায়িত্ব নির্ধারিত করে দিয়েছেন (তা পালন করো)। তিনি কিছু নিয়ম-কানুন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন (সে অনুযায়ী চলো)।
কিছু জিনিস হালাল করে দিয়েছেন (তা ভোগ করো)। কিছু জিনিস হারাম করে দিয়েছেন (তা পরিহার করো)। তোমাদের জন্য তিনি যে দ্বীন নির্ধারিত করেছেন তা সরল, সোজা ও সহজ। তা ব্যাপক ও বিস্তৃত। দ্বীন তিনি সংকীর্ণ করেননি (তোমরাও করো না)।” (তারগীব ও তারহীব, তাবরানী)
- ব্যাখ্যাঃ শেষ অংশের অর্থ হলো, দ্বীনের আহকাম অনুযায়ী আমল করলে মানুষের জীবন সংকীর্ণ ও সঙ্কুচিত হয় না। ইসলাম মানুষের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। দ্বীনের রাস্তা অত্যন্ত প্রশস্ত ও সহজ, এখানে সংকীর্ণতা ও অন্ধত্বের কোন কোন স্থান নেই।
কুরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক
হযরত আবু শুরাইহ্ খুযায়ী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, 'আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তোমরা কি এর সাক্ষ্য প্রদান করো না? জবাবে সবাই বললাম, 'হ্যাঁ, আমরা এ দু'টি কথারই সাক্ষ্য দান করি।'
এরপর তিনি বললেন, ‘এ কুরআনের একটি প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অন্য প্রান্তটি তোমাদের হাতে। তাই তোমরা কোরআনকে শক্ত করে ধরে রাখো, তাহলে তোমরা কখনো সরল সোজা পথ থেকে বিভ্রান্ত হবে না এবং ধ্বংসের মধ্যে নিমজ্জিত হবে না। (তারগীব ও তাহরীব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসিয়ত
- ব্যাখ্যাঃ আল্লাহতায়ালা এই কিতাবকে 'হাবলুল্লাহ' (আল্লাহর রশি) বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য হাসিল, তাঁর সন্তুষ্টি লাভ এবং দুনিয়া ও আখেরাত উভয়স্থানেই তাঁর রহমত পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো কুরআন।
সুন্নাত ও বিদয়াতের মধ্যে পার্থক্য
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ হজ্জের ভাষণে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা শক্তভাবে ধরে থাকো তাহলে কখনো গোমরাহ হবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাত।' (তারগীব ও তারহীব)
কোরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ
হযরত আমর ইবনে আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, “একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলাল ইবনে হারিস রাদিয়াল্লাহুকে বললেন, “হে বিলাল, জেনে রেখো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে কি জেনে রাখতে বলছেন?' তিনি বললেন,
'জেনে রেখো, যে ব্যক্তি আমার কোন সুন্নত বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তা চালু করবে সে ওই সুন্নতের ওপর আমলকারীদের সমান সওয়াব পাবে কিন্তু তাতে আমলকারীর প্রতিফলের কোন অংশ কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ বিরোধী কোন নতুন জিনিস দ্বীনের সঙ্গে জুড়ে দেবে সে ওই বিদয়াতের ওপর আমলকারীদের সমান শাস্তি পাবে কিন্তু তাতে করে আমলকারীদের শাস্তির কোন অংশই কম করা হবে না।' (তিরমিযী)
সুন্নতের ফজিলত
হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'আমার উম্মতের মধ্যে যখন সাধারণভাবে ভাঙন দেখা দেবে তখন যে আমার সুন্নাত অনুযায়ী চলবে সে একশো শহীদের সমান পুরস্কার পাবে।” (তারগীব ও তারহীব)
- ব্যাখ্যাঃ এত বড় পুরস্কার পাওয়ার কারণ, সে যে পরিবেশের মধ্যে ছিল তাতে রাসূলের পথে চলা তার জন্য সহজ ছিল না, চারদিকেই ছিল প্রতিকূলতার বেড়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে মানুষের পছন্দনীয় পথ ধরেনি, বরং সে তার সমস্ত জীবন ধরে এই সাক্ষ্যই দিয়ে গেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো রাস্তাই হলো পরিত্রাণের উপায়।