ফেরেশতারা কিসের তৈরি
ফেরেশতারা কিসের তৈরি
ফেরেশতারা নূর বা আলোর তৈরি হয়ে থাকে। তারা মানুষের চোখের অন্তরালে। মানে মানুষ সচরাচর ফেরেশতাদের দেখতে পান না। এরা নুরের তৈরী। নুর অর্থ অনেকে আলোক বলে থাকেন।
ফেরেশতা কোন ভাষার শব্দ
'ফেরেশতা' মূলত একটি ফার্সি শব্দ। আরবি মালাকুন ও 'মালাইকা' শব্দের প্রতিশব্দ এটা। কোরআন ও হাদিসে 'মালাইকা' শব্দটিই ব্যবহৃত হয়।
কুরআনে কতজন ফেরেশতার নাম আছে
কুরআনে ফেরেশতা মোট কতজনার নাম আছে তা নিচে দেওয়া হলো।
জিবরাঈল (আ.)
মিকাইল (আ.)
মালেক (আ.)
হারুত-মারুত (আ.)
মালাকুল মাওত বা আজরাইল আ.
ইসরাফিল (আ.)
প্রধান ফেরেশতা কতজন
প্রধান ফেরেশতা মোট চারজন যথা নিচে দেওয়া হলো।
জিবরাঈল (আ.)
মিকাইল (আ.)
মালেক (আ.)
হারুত-মারুত (আ.)
মালাকুল মাওত
ইসরাফিল (আ.)
প্রধান চার ফেরেশতার কাজ কি
জিবরাঈল (আ.) ওহী নাযিল করার দায়িত্ব
মিকাইল (আ.) তিনি বৃষ্টি বর্ষণ, উদ্ভিদ উৎপাদন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত
মালাকুল মাওত বা আজরাইল আ. প্রাণীকুলের জান কবজের কাজে নিয়োজিত
ইসরাফিল (আ.) আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে শিংগায় ফুৎকার দেবেন।
আদম (আ) সম্পর্কে ফেরেশতাদের অবহিত করার কারণ
“হে রাসূল (স্মরণ করুন) যখন আপনার রব ফিরিশাতাদেরকে বললেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা পাঠাচ্ছি। তখন তারা বলল, আপনি কি এমন কাউকে নিয়োগ করতে চান, যে সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং খুনাখুনি করবে? আমরাই তো আপনার তাসবীহ ও তাকদীস (পবিত্রতা) করছি। তখন আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জান না।” (সূরা বাকারা)
মহান রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে মানুষকে খলিফা হিসেবে পাঠাবেন, এ সম্পর্কে ফেরেশতাদেরকে জানানোর কারণ কি? ফেরেশতাসহ মহাবিশ্বে যা কিছু আছে সমস্ত কিছুই যেখানে আল্লাহ নিজেই সৃষ্টি করেছেন, সেখানে মানুষকে খলিফা হিসেবে পাঠানোর পূর্বে ফেরেশতাদেরকে জানানোর মাঝে নিশ্চয় কোন গোপন রহস্য বিদ্যমান রয়েছে।
সৃষ্টি জগতের সমস্ত কাজের দায়িত্ব ফেরেশতারা পালন করে থাকে। ফেরেশতারা আল্লাহর আজ্ঞাবহ প্রহরী ও শ্রমিক। যখন যেখানে যে দায়িত্ব দিয়ে তাদের পাঠানো হয়, তৎক্ষণাৎ তারা তা পালন করে। তাই বিশ্ব মালিকের পক্ষ থেকে নতুন কোন শাসন ব্যবস্থার নীতি প্রবর্তন করার আগে ফেরেশতাদেরকে অবহিত করতে হয়।
জগতের কোন জীব আল্লাহর আনুগত্যের বিরোধীতা করতে পারে না। যখনি কোন জীব আল্লাহর আনুগত্যের বিরোধীতা করত তখন সাথে সাথে ফেরেশতারা তাদের ধড়পাকড় করে শায়েস্তা করত। জীব ও জগতের সাংগঠনিক বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে এ নীতিই চালু ছিল।
ফলে ফেরেশতাদের স্রষ্টার এ নীতি সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবহিত ছিল বলে, সেভাবেই দায়িত্ব পালন করত। অতঃপর যখন বিশ্ব শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে স্রষ্টা নিজেই নতুন কর্মনীতি চালু করার চিন্তা করলেন, তখন এ সম্পর্কে ফেরেশতাদেরকে অবহিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়, কারণ নতুন এ কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ফেরেশতাদের কোন ধারণা ছিল না।
পৃথিবীতে আদমকে খলিফা হিসেবে পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত
পৃথিবীতে আদমকে খলিফা হিসেবে পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত যত জীব পৃথিবীতে বসবাস করছিল, তাদের মধ্যে কোন জীব প্রজাতির প্রাণীরই ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা ছিল না। কোন প্রাণীই অন্যায়, অবিচার করতে পারত না। যখনি তারা আল্লাহর আনুগত্যের বিরোধিতা করত তখনি ফেরেশতারা তাদেরকে আযাব-গজব দিয়ে ধ্বংস করে দিত।
আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদেরকে তাঁর শাসন ব্যবস্থার এ নীতি আগেই শিখিয়ে রেখে ছিলেন। তাই ফেরেশতারা পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করে যাচ্ছিল। এবার যখন স্রষ্টা আদমকে ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতা দিয়ে দুনিয়ায় পাঠাতে মনস্ত করলেন তখন ফেরেশতাদেরকে তিনি বিশ্বশাসন ব্যবস্থার দ্বিতীয় ও নতুন কর্মপদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার জন্য অবহিত করলেন।
ফেরেশতাগণের নিজস্ব কোন চিন্তা শক্তি নেই
ফেরেশতাগণের নিজস্ব কোন চিন্তা শক্তি নেই। তাদেরকে পূর্ব থেকে কাজের জন্য জ্ঞান দিয়ে দিতে হয়। কম্পিউটারের মেমোরীতে যেমন কাজ করার জন্য পূর্বেই অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান দিয়ে দিতে হয় তেমনি ফেরেশতাদেরকে তাদের কর্মনীতির জ্ঞান আগেই দিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে তারা নতুন কাজে সাহায্য-সহযোগিতা তো করেই না বরং বাধা সৃষ্টি করে।
আদমের বংশধর আসবে ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতা নিয়ে
এবার আদম ও আদমের বংশধর আসবে ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতা নিয়ে। তারা ভাল-মন্দ, ফেত্না-ফাসাদ, রক্তারক্তি উভয় কাজই করবে। এমন কি তারা আল্লাহর আনুগত্যের বিরোধীতা পর্যন্ত করতে পারবে। এর জন্য দুনিয়াতে তাদের ধর পাকড় করা যাবে না।
এখন থেকে আদম ও আদমের বংশধর ভাল-মন্দ যাই করুক না কেন, ফেরেশতাদের আর বাধা দেয়ার অধিকার নেই। নীরবে তাদের কাজের সহযোগিতা বা আনুগত্য করতে হবে। এ সংবাদ ও কর্মনীতি জানানোর জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বিষয়টি অবহিত করলেন।
ফেরেশতাদের আনুগত্য করার বিষয়
ফেরেশতাদের আনুগত্য করার বিষয়টি আল কোরআনে সেজদা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। এ সিজদা আমাদের ন্যায় নামাজে সিজদায়রত হওয়া নয়। বরং তা হলো আনুগত্য প্রকাশ। নিম্নে আয়াতে সে কথারই উল্লেখ রয়েছে-
“যখন আমি বললাম ফেরেশতাদেরকে সেজদায় পতিত হও আদমের সম্মুখে, সকলেই সেজদায় পতিত হল ইবলীস ব্যতীত।” (সূরা বাকারাহ: ৩৪)
আদমকে সেজদা করার অর্থ হলো
মূলত আদমকে সেজদা করার অর্থ হলো তাদের ভাল-মন্দ সকল কাজে আনুগত্য করা। এ শিক্ষার মাধ্যমে ফেরেশতাগণকে জ্ঞান দিয়ে দেয়া হল। স্রষ্টার বিশ্বশাসন ব্যবস্থার দ্বিতীয় কর্মপদ্ধতি পূর্বের চেয়ে ভিন্ন ছিল বিধায় খলিফা পাঠানোর কথা জানানো হলে তারা জানার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আপত্তি তুলেছিল।
তারা ভেবেছিল হয়ত আবারও প্রথম শাসন পদ্ধতির অধীনেই নতুন কোন মানব প্রজাতি সৃষ্টি করা হবে। কারণ তারা স্রষ্টার প্রথম শাসন পদ্ধতির অধীনে এমন এক মানব প্রজাতি পেয়েছিল, যারা দুনিয়ায় ফ্যাত্না-ফ্যাসাদ ও রক্তারক্তি করেছিল।
এদেরকে তারাই আযাব-গজব দিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে। কিন্তু আল্লাহ যখন তাদেরকে দ্বিতীয় শাসন পদ্ধতির কথা জানালেন। তখন তারা বলল-আমাদের জ্ঞান নেই উহা ব্যতীত, যা আপনি আমাদেরকে শিখাইয়াছেন।”
আদমকে দুনিয়ায় খলিফা হিসেবে পাঠানো
আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আদম (আ) কে দুনিয়ায় পাঠানোর আগে ফেরেশতাদেরকে জানানো এটাই মূল কারণ। এরপর আরও কোন গোপন রহস্য বিদ্যমান আছে কিনা তা আল্লাহই ভাল জানেন।
আদমকে দুনিয়ায় খলিফা হিসেবে পাঠানোর আগে ফেরেশতাগণকে জানানো যেমন রহস্যপূর্ণ, তেমনি আদমকে নাম শিক্ষা দেয়ার বিষয়টিও সে পর্যায়ের। ফলে এ বিষয়টিরও আমাদের তলিয়ে দেখা প্রয়োজন৷
ফেরেশতাদের নামের তালিকা
প্রধান চার ফেরেশতার নাম নিচে দেওয়া হলো।
জিবরাঈল (আ.)
মিকাইল (আ.)
মালেক (আ.)
হারুত-মারুত (আ.)
আজরাঈল (আ.) মালাকুল মাওত
ইসরাফিল (আ.)
ফেরেশতাদের অস্তিত্ব ও জ্ঞানের পরিধি
ফেরেশতা কিসের তৈরি
ফেরেশতা হলো আল্লাহ তা'য়ালার সৃষ্ট অদৃশ্য সত্তা। ফেরেশতাদের না দেখেই বিশ্বাস করা ঈমানের শর্ত। কারণ অদৃশ্য জিনিস দেখা মানুষের ক্ষমতার আওতাধীন নয়। সে হিসেবে আল্লাহ এবং ফেরেশতাদেরকে না দেখেই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। এটাই ঈমানের দাবী।
তাই ঈমানদার ও আস্তিকগণ না দেখেই আল্লাহ তা'য়ালাকে এবং ফেরেশতাদেরকে বিশ্বাস করে থাকেন। কিন্তু নাস্তিকরা যে জিনিস দেখে না তা বিশ্বাস করতে রাজী নয়। কিন্তু সব জিনিস যে দেখেই বিশ্বাস করতে হবে এমন যুক্তি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও অযুক্তিক।
কারণ আধুনিক বিজ্ঞানে এমন কিছু অদৃশ্য জিনিস আছে, যেগুলি না দেখেই বিশ্বাস করা হয়। যেমন কোয়ার্ক ও এন্টিকোয়ার্ক। তাছাড়া রয়েছে ধ্বনাত্মক তথ্যকণা (Positive Information bit) ও ঋণাত্মক তথ্য কণা (Negative Information bit)।
এখানে আদেশ তথ্য কণা বা তথ্য তরঙ্গের সাথে ফেরেশতাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক থাকতে পারে। এ সবগুলোর অস্তিত্ব যুক্তি, ব্যাখ্যা, অনুমান ও অনুভবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবু বিজ্ঞানের ভাষায়ও এদের নাম ও অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অথচ এগুলোর কোনটাই দেখা যায়না।
পৃথিবীতে একই জিনিসের ভাষাগত ব্যবধানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নাম: হয়েছে। যেমন আমরা যাকে পানি বলি এটাকেই ইংরেজী ভাষায় Water বলা হয়। আবার আরবী ভাষায় একেই 'মা' বলা হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে এখনও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়নি এ কথা সত্য কিন্তু ধর্মীয় ভাষায় যাকে আমরা ফেরেশতা বলি এমনও হতে পারে বিজ্ঞানের ভাষায় তাকেই অন্য নাম দেয়া হয়েছে।
মিকাইল ফেরেশতার কাজ কি
মিকাইল ফেরেশতার কাজ হচ্ছে, মেঘমালার রক্ষণাবেক্ষন, বৃষ্টি পরিচালনা ইত্যাদি।
ফেরেশতারা কিসের তৈরি ও তাদের ঘুম-নিদ্রা
ফেরেশতাগণ অদৃশ্য সত্তা। তাদের কোন প্রবৃত্তি নেই। তাদের খাওয়া-দাওয়া ঘুম-নিদ্রার প্রয়োজন পড়ে না। তারা পুরুষ-নারী এ শ্রেণীর কিছু নয়। অর্থাৎ ধ্বনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জ বা গুণ তাদের মধ্যে নেই। তারা নৈব্যক্তিক পর্যায়ের। তারা কাপড় পরিধান করে না, স্ত্রী সহবাসও করে না।
এরা নুরের তৈরী। নুর অর্থ অনেকে আলোক বলে থাকেন। কিন্তু আলোক তো আমরা দেখতে পাই। মূলত আমরা যে আলোক শক্তিকে দেখে থাকি তা প্রকৃত নুর নয়। নুর তার চেয়ে আরও সূক্ষ্ম জিনিস। যা কোয়ার্ক পর্যায়ের চেয়েও আরও সূক্ষ্ম। এমন সূক্ষ্ম সত্তা শোষণ বা আহার করে না। তাই তাদের থেকে বিকিরণও হয় না। আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করাই তাদের কাজ।
তারা আল্লাহর হুকুমে যে কোন অদৃশ্য আকার ধারণ করতে পারে। তাদের আকৃতি একই সাথে অনেকের দৃষ্টিগোচর না হলেও যাকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো হয়, তিনিই শুধু তাদেরকে দেখতে পান। যেমন সাহাবীদের সামনে হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নিকট জিব্রাঈল (আ) আসলেও তাঁরা জিব্রাইল (আ) কে দেখতেন না। কিন্তু নবীজি (সা) অন্যান্য জিনিসের মতোই তাঁকে দেখতে পেতেন।
মালাকুল মাওত বা আজরাইল (আ.)
আবার অনেক সময় দেখা যায় মৃত্যু পথযাত্রীগণ বার বার চোখ ঢাকতে থাকে। কেন তারা চোখ ঢাকে আমরা জানি আল্লাহ তা'আলার এক ফেরেশতা মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় ৷ যেহেতু মৃত্যু পথযাত্রী বার বার চোখ ঢাকে, এতেই বুঝা যায় আল্লাহর সেই ফেরেশতা (মৃত্যুদূত) আযরাইল (আ) অদৃশ্য আকৃতি নিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী. ব্যক্তির সামনে আসেন।
ফলে সে ভয়ে আতংকিত হয়ে চোখ ঢাকে অথবা ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে আল্লাহ তা'আলার ফেরেশতা অসংখ্য। কেউ জমিনে দায়িত্ব পালন করে। আবার কেউ কেউ আসমানে দায়িত্ব পালন করে।
এদের মধ্যে প্রধান ফেরেশতাগণ বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব পালন করে। তাঁরা কখনো আল্লাহর আনুগত্যের বিরোধী হয় না এবং আল্লাহ যা আদেশ করেন তাই তারা পালন করে। পাক কোরআনে আল্লাহ তা'আলা সে কথাই উল্লেখ করেছেন,
“তারা কখনও আল্লাহ যা হুকুম করেন, তা লংঘন করে না এবং যা আদেশ করেন তাই পালন করে।” (আল কোরআন)
ফেরেশতাদের অস্তিত্বের ধারণা দিতে গিয়ে আমি তাঁদের (ফেরেশতা) অস্তিত্বের সাথে স্রষ্টার “কমান্ড আদেশ”-এর সম্পর্ক থাকার কথা বলেছি। নিম্নের আয়াত থেকে সে তথ্যেরই সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে স্বীয় আদেশের সাথে কমাণ্ড আদেশ এর সম্পর্ক রয়েছে।
“তিনিই আল্লাহ যিনি সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং অনুরূপ সংখ্যক পৃথিবীকেও এবং তিনি তাদের মধ্যে স্বীয় আদেশ অবতীর্ণ করেন যেন তোমরা অবগত হও যে, নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়োপরি শক্তিমান, নিশ্চয় আল্লাহ স্বীয় জ্ঞান দ্বারা সমস্ত বিষয় পরিবেষ্টন করে আছেন।” (৬৫: ১২)
ফেরেশতাগণের অস্তিত্ব নিখুঁতভাবে বুঝতে হলে
ফেরেশতাগণের অস্তিত্ব নিখুঁতভাবে বুঝতে হলে আমাদেরকে নিজ দেহ রাজ্যের কার্যব্যবস্থার নিগূঢ় তত্ত্ব অন্তর চোখ খুলে দেখতে হবে।
কারণ আমাদের দেহ রাজ্যের কার্যব্যবস্থা ও আল্লাহর বিশ্ব রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত প্রায় একই রকম। উপরের আয়াতে “স্বীয় আদেশ” ও কমাণ্ড আদেশ একই পর্যায়ের সম্বন্ধযুক্ত শব্দ। আল্লাহর আদেশ বার্তা ফেরেশতাগণই নিয়ে আসেন।
আল্লাহ তা'আলার সৃষ্ট জগৎ চিরন্তন নয়। সমগ্র বিশ্ব তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। এক সাথে সৃষ্টির রেণুকণা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব।
আল্লাহ বলেন- “আমি তাদেরকে বাহ্যিক জগতে ও তাদের (অর্থাৎ মানুষের) দেহ ও আত্মার মধ্যে আমার ক্ষমতার নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে থাকি। যার ফলে সত্যের গুরুত্ব তাদের নিকট প্রকাশিত হবে।” (সূরা হামীম আস সাজদাহ রুকু-৫)
বিশ্বজগৎ আল্লাহর রাজ্য
এ বিশ্বজগৎ আল্লাহর রাজ্য। একে স্রষ্টার ইচ্ছা শক্তির প্রকাশের ঘণীভূত অবস্থাও বলা চলে। কিংবা থিওসফির ভাষায়-“চিন্তামূর্তি” বলা চলে। মানুষের আত্মার প্রকাশ আবরণ হলো তার দেহ রাজ্য। মানুষের এ দেহ রাজ্য শাসন বা পরিচালনা করার জন্য যেমন রয়েছে স্নায়ু ব্যবস্থা, তেমনি স্রষ্টার এ বিশ্ব ভূবন শাসনের জন্য রয়েছে অদৃশ্য স্নায়ু রজ্জু।
সেই অদৃশ্য স্নায়ূ রজ্জুর সাথে ফেরেশতাদের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। তাই আমাদেরকে ফেরেশতাদের অস্তিত্ব অনুভব করার জন্য নিজ দেহ রাজ্যের নিগূঢ় তথ্য সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।
আল্লাহ বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ আদমকে নিজ অনুরূপে সৃষ্টি করেছেন। (আল কোরআন)
এখানে আদমের দেহ আল্লাহর দেহের অনুরূপ এই অর্থে উপরের আয়াতকে বুঝলে চলবে না। কারণ আল্লাহ নিরাকার অনন্ত, অসীম। তাঁর সাথে আকার, আকৃতির এবং গতির কোন সম্পর্ক নেই।
বরং এ আয়াতের মর্মার্থ হলো আদমের দেহ রাজ্য শাসন ব্যবস্থার নমূনা স্রষ্টার বিশ্ব ভূবন শাসনের অনুরূপ। তাই আমাদেরকে মানব দেহের স্নায়ু ব্যবস্থার কার্যধারা স্রষ্টার বিশ্ব শাসন ব্যবস্থার কার্যধারার নিয়ম নীতির অনুরূপ এটিই বুঝতে হবে।
মানব দেহের মূল সচিবালয় হলো মস্তিষ্ক
মানব দেহের মূল সচিবালয় হলো মস্তিষ্ক। তেমনি স্রষ্টার মূল সচিবালয় হলো আ'রশ। এখানে উভয়ের মাঝে ব্যবধান হলো মানুষের স্নায়ুব্যবস্থায় শাখা প্রশাখা অদৃশ্য নয়। কিন্তু স্রষ্টার আরশের স্নায়ু রজ্জু অদৃশ্য। আত্মা বা রূহ্ যেমন মস্তিষ্কের মাধ্যমে দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি স্রষ্টা আ’রশের মাধ্যমে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
আত্মার নির্দেশ মস্তিষ্ক হয়ে যেমন দেহের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যায় তেমনি স্রষ্টার আদেশ তথ্য তরঙ্গ (Command Information bit) আ'রশ হয়ে মহাবিশ্বের সকল স্থানে গমন করে। মানুষের স্নায়ু ব্যবস্থাতে রয়েছে দু'ধরনের স্নায়ু।
এক ধরনের স্নায়ু দেহের নিম্নাংশের খবর মস্তিষ্কে পৌঁছায়। অপর ধরনের স্নায়ু মস্তিষ্কের খবর দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যায়। উভয় ক্ষেত্রে একটা Impulse ৰা খবর আদান-প্রদান করে। কিন্তু এই Information bit এর প্ররোচনায় বা তথ্যের সংকেত অনুযায়ী মস্তিষ্ক বা স্নায়ুর প্রান্তে এক ধরনের জৈব রস (রাসায়নিক পদার্থ) নিঃসৃত হয়।
এটিই অঙ্গটিকে কাজ করাতে বাধ্য করে। মানুষের স্নায়ু ব্যবস্থার এই উপাদান (জৈব রস) দেখা যায় এবং ঔষধ হিসেবে তৈরীও করা যায়। কিন্তু স্রষ্টার আ'রশের রজ্জুর সত্তা দেখা যায় না এবং কৃত্রিমভাবে তৈরীও করা যায় না। মূলত স্রষ্টার আ'রশের রজ্জু বেয়ে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যে অদৃশ্য সত্তা অস্তিত্ব ধারণ করে তার সাথে ফেরেশতাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক রয়েছে।
ফেরেশতাদের অস্তিত্ব
আমি ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার লেখা “সৃষ্টি ও স্রষ্টার রহস্য” গ্রন্থে বিশদ আলোচনা করেছি। পাঠক মহলের কাছে বিষয়টি আরও ব্যাপক ভাবে জানার জন্য সে গ্রন্থটি পড়ার জন্য অনুরোধ রইল। কারণ আদমের আদি উৎস সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই ফেরেশতাদের সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আত্মিক আদম সম্পর্কে আমার ধারণা, হতে পারে সে সত্তার অস্তিত্ব Positive Information bit জাতীয় কোন অদৃশ্য সত্তা।
সে হিসেবে ফেরেশতাদের অস্তিত্ব হলো Neutral Information bit জাতীয় বিশেষ ধরনের কোন অদৃশ্য সত্তা। এ অদৃশ্য সত্তা Command Information bit হলেও তার চরিত্র Neutral (নিরপেক্ষ ধরনের)। তাদের মধ্যে পুরুষ-নারীর মতো গুণ নেই। এরা প্রয়োজনে আল্লাহর নির্দেশে বিশেষ মুহূর্তে যে কোন আকৃতি ধারণ করতে পারে। এদের আকৃতি এক সাথে অনেকের দৃষ্টি গোচর হয় না। যখন যার কাছে গমন করে সেই শুধু তার অস্তিত্ব দেখে থাকে।
এরা তরঙ্গ হিসেবেও থাকতে পারে। আবার বিশেষ কোন মুহূর্তে নির্দিষ্ট কোন আকৃতি ধারণ করে ক্ষণিকেই মিলিয়ে যেতে পারে। টিভির প্রেরক যন্ত্রের স্ক্যানিং বিন্দুগুলি ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিভ ওয়েভ হয়ে আকাশ পথে চলতে চলতে যখন গ্রাহক যন্ত্রে ধরা পড়ে তখন পূর্বের আকৃতি ফিরে পায়। তারপর যতক্ষণ ঘটনাটি চলতে থাকে ততক্ষণ দৃশ্যটি দেখা যায়, তারপর আবার অদৃশ্য। হয়ে যায়।
কিন্তু তার অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যায় না। তরঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায় মহাকাশ জুড়ে। সে আলোকে আল্লাহর আদেশ তথ্য তরঙ্গ “তথ্য মূর্তি” ধারণ করতে পারে। কিংবা “ফোটন-চুম্বক তরঙ্গ” হয়ে আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে।
এর চেয়ে সহজ ভাষায় ফেরেশতাদের অস্তিত্ব বর্ণনা করার কোন উপায় নেই। কারণ ফেরেশতাগণ গায়েবে থাকেন বলে তাদের ডেকে এনে দেখানো সম্ভব নয়। তাই গায়েবের প্রতি বিশ্বাস করা ফরজ। অর্থাৎ বিশ্বাসে যেমন রয়েছে মুক্তি তেমনি নিজের মধ্যেই রয়েছে জগৎ-মহাজগতের কুদরতের নিদর্শন।
আল্লাহ বলেন-“তোমার নিজের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন; তুমি কি তা দেখ না।” (আল কোরআন)
ফেরেশতাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত
ফেরেশতাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত। তারা চিন্তা করে কোন কিছু আবিষ্কার করতে পারে না। আবার কোন প্রশ্নের জবাবও দিতে পারে না। এদের কাজ একমুখী অর্থাৎ এদের মধ্যে কেহ উর্ধ্বজগতের দায়িত্ব পালন করে, আবার কেহ নিম্ন জগতের দায়িত্ব পালন করে।
টিভি ও রোবোট মানুষের আবিষ্কৃত দু'টি যন্ত্র। টিভির মাধ্যমে প্রেরক যন্ত্রের তথ্য ও ছবি প্রদর্শন হয়। কিন্তু সে প্রেরক যন্ত্রের কাছে কোন তথ্য পাঠাতে পারে না। অপরদিকে রোবোটের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান দু'টিই হয়। এক্ষেত্রে টিভি এবং রোবোটের কাজ যেমন ভিন্ন তেমনি ফেরেশতা ও মানুষের কাজের রয়েছে ভিন্নতা।
কম্পিউটার বা রোবোটে পূর্ব থেকে জ্ঞান দেয়া না থাকলে যেমন সেগুলো কোন তথ্য দিতে পারে না তেমনি আদমকে পূর্ব থেকে জ্ঞান দেয়া ছিল বলে তিনি জিনিসের নাম বলতে পেরেছিলেন। কিন্তু ফেরেশতাদের মধ্যে সে জ্ঞান দেয়া ছিল না বলে তারা কোন জিনিস দেখেও তথ্য প্রেরণ করতে পারে নি। তাদের মধ্যে একই সাথে তথ্য আদান প্রদান করার ব্যবস্থা নেই।
একদল উর্ধ্বজগৎ থেকে তথ্য নিয়ে আসে। অপর দিকে অন্য দল নিম্ন জগৎ থেকে উর্ধ্বজগতে তথ্য দিয়ে যায়। এক্ষেত্রে মানুষের জড়দেহের একটি জীবকোষ থেকেও তথ্য আদান-প্রদান হয়। তাই ফেরেশতাদের জ্ঞানের পরিধি মানুষের চেয়ে একান্তই কম বা সীমিত। নিম্নের হাদীসে কুদসীর একটি উদ্ধৃতি থেকে সে ধারণা নিতে পারি।
“নিশ্চয়ই ফেরেশতাগণ বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনি বনী আদমকেও সৃষ্টি করেছেন।
অতঃপর আপনি তাদেরকে এরূপ স্বভাব দান করেছেন যে, তারা খাদ্য খায়, পানীয় পান করে, কাপড় পরিধান করে, স্ত্রী সহবাস করে, চতুষ্পদ পশুর পিঠে আরোহণ করে, নিদ্রা যায় এবং বিশ্রাম করে। কিন্তু আপনি তাদের জন্য দুনিয়া নির্ধারিত করে দিন।
আর আমাদের জন্য আখিরাত।” তখন মহান ও মর্যাদাশীল আল্লাহ বললেন, “আমি যাকে স্বহস্তে তৈরী করেছি এবং যাতে আমার সৃষ্ট রূহ ফুঁকে দিয়েছি, তাকে ইহার মত করব না। যা হোক, আমি বলেছি, ‘হয়ে যাও, তখনই ইহা হয়ে গেল।” (হাদীসে কুদসী
ফেরেশতাদেরকে বলতে পারি আল্লাহর আনুগত্যশীল দূত
সাহিত্যের ভাষায় ফেরেশতাদেরকে বলতে পারি আল্লাহর আনুগত্যশীল দূত। থিওসফির ভাষায় “তথ্য মূর্তি”। বিজ্ঞানের ভাষায় “নিরপেক্ষ তথ্য কণা” বা ফোটন চুম্বক-তরঙ্গ ইত্যাদি। এবার যুক্তির ইতি টেনে সত্যের নিগুঢ় রহস্যের সন্ধানে সকলকে কোরআনের দিকে ফিরে আসার আহবান জানাই।
আর মনে করে দিতে চাই আদমের সৃষ্টি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, কোরআনের সাথে যাচাই বাছাই করে দেখুন। দেখুন কোনটি সত্য আর কোনটি পৌরাণিক কাহিনী।
ইমাম গাযযালী (র) ফেরেশতাদের সম্পর্কে তথ্য
উপসংহারে ইমাম গাযযালী (র) ফেরেশতাদের সম্পর্কে যে তথ্য তুলে ধরেছেন তার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে এ অধ্যায়ের সমাপ্তি টানা হলো।
যে সূক্ষ্ম শক্তি তোমার মস্তিষ্কে থেকে স্নায়ুসমূহকে আলোড়িত করে এবং তার সাহায্যে হাতের অঙ্গুলী ও অবশেষে কলম পরিচালিত করে তদরূপ এক প্রকার শক্তি আরশ ও কুর্সীতে অবস্থান করে আকাশ ও গ্রহ নক্ষত্রগুলোকে পরিচালিত করে এবং ইহার প্রভাব নিম্ন জগৎ পৃথিবী ও পৃথিবীস্থ প্রকৃতিকে আলোড়িত করে। শেষোক্ত শক্তিকে ফেরেশতা বলে। (সৌভাগ্যের পরশমণি -৬০)
সংগৃহীতঃ আদমের আদি উৎস
লেখকঃ আল মেহেদী
পোস্ট ট্যাগঃ