মৃত্যুর যন্ত্রণা
মৃত্যুর যন্ত্রণা
রুহ
কবজ করা একটি ভয়ানক
কাজ। এ কাজে মালাকুল
মউত নিয়োজিত। হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,
মুকাতিল রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ্
তা'আলা আজরাঈল আঃ
-এর জন্য সপ্তম আসমানে,
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে
চতুর্থ আসমানে সত্তর হাজার খুটির উপর নূরের একটি
সিংহাসন তৈরি করেছেন। তাঁর
শরীরে চারটি পাখা সারা শরীরে
সকল প্রাণির সংখ্যানুপাতে চোখ ও জিহ্বা
রয়েছে।
মালাকুল মউত
হাদীসের
অপর এক বর্ণনায় এসেছে,
রাসূল সা. বলেছেন: মালাকুল
মউতের ডানে, বামে, উপরে, নীচে এবং সামনে
ও পেছনে ছয়টি মুখ রয়েছে। উপস্থিত
সাহাবাগণ আরজ করলেন, হে
আল্লাহর রাসূল সা.! ছয়টি মুখ
কেন? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন: ডান
পাশের মুখ দিয়ে পাশ্চাত্যের
আর বাম পাশের মুখ
দিয়ে প্রাচ্যের, পেছনের মুখ দিয়ে পাপী
দের আর উপরের মুখ
দিয়ে আকাশবাসীর এবং নীচের মুখ
দিয়ে দৈত্য-দানবের রুহ কবজ করেন।
রাসূলুল্লাহ্
সা. আরো বলেনঃ আজরাঈলের
চারটি মুখ রয়েছে। মাথার
উপরের মুখ দ্বারা নবী
ও ফেরেশতাদের আত্মা, সামনের মুখ দ্বারা মুমিন
বান্দাদের আত্মা, সামনের মুখ দিয়ে মু'মিনের, পেছনের মুখ দ্বারা দোযখীদের
এবং পদতলস্থ মুখ দৈত্য-দানব,
জ্বিন ও শয়তানের আত্মা
কবজ করে থাকেন। তার
একটি পা দোযখের উপরস্থিত
পুলসিরাতের উপর অপরটি জান্নাতে
অবস্থিত সিংহাসনের উপর।
আজরাঈলের (আঃ) দেহ
হাদীসের
অপর এক নির্ভরযোগ্য তথ্যের
ভিত্তিতে জানা যায় যে,
আজরাঈলের দেহ এত বড়
যে, পৃথিবীর সকল নদী-নালা,
সাগর-সমুদ্রের সব পানিও যদি
তার মাথায় ঢেলে দেয়া হয়,
তবুও এক ফোঁটা পানি
মাটিতে গড়িয়ে পড়বে না। তার সামনে
পৃথিবীর আত্মাসমূহ এতই ছোট, যেন
বিভিন্ন খাদ্যে পরিপূর্ণ একটি থালা তাঁর
সামনে রেখে দেয়া হয়েছে
এমন। আর তিনি যেখান
থেকে যা এবং যতটুকু
ইচ্ছা খেতে পারেন।
প্রখ্যাত
সাহাবী কা'ব রা.
হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহ্
তা'আলা স্বীয় আরশের
নিচে একটি বৃক্ষ সৃষ্টি
করে রেখেছে। উক্ত বৃক্ষে জীবিত
মানুষের সংখ্যানুপাতে পাতা সৃষ্টি করে
রেখেছেন। তার প্রত্যেকটি পাতায়
মানুষের নামসমূহ আলাদাভাবে লিখে রেখেছেন।
মৃত্যু আমাকে ডাকছে
যে
সময় যে মানুষের হায়াত
শেষ অবস্থায় পৌঁছানোর চল্লিশ দিন বাকী থাকে,
তখন সে বৃক্ষ থেকে
উক্ত লোকের নাম ও ঠিকানা
লিখিত পাতাটি মালাকুল মউতের সামনে পড়ে যায়। সাথে
সাথে মালাকুল মউত অনুভব করেন
যে, অমুক ব্যক্তির রুহ
কবজ করার আর মাত্র
চল্লিশ দিন বাকি রয়েছে।
তখন হতে মালাকুল মউত
এ ব্যক্তির রুহ কবজ করার
প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
কাজেই
ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর চল্লিশ দিন পূর্বেই তাঁর
মৃত্যুর খবর আসমানে প্রচারিত
হতে থাকে। যদি ঐ লোকটি
পৃথিবীতে চিন্তাহীনভাবে আরাম আয়েসের মধ্যে
জীবন অতিবাহিত করতে থাকে, তার
জন্য আফসোস! মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তি কিংবা পৃথিবীর অন্য কোন মানুষের
পক্ষেও তা অনুধাবন করা
সম্ভব নয় যে, সে
আর কতদিন পৃথিবীতে বসবাস করার সুযোগ অর্জন
করবে।
মৃত্যু অর্থ কি
এ ছাড়া ঐ লোকটি চল্লিশ দিন পর্যন্ত যে, কত অপরাধের কাজে লিপ্ত হবে, তার হিসাব কে রাখবে? ঐ ব্যক্তি নিজেও জানে না যে, তার মৃত্যু আসন্ন, সে কী করছে, কোথায় তার গন্তব্য স্থান, হয়তো বা ঐ সময়ের মধ্যে সে সমস্ত অপরাধের কাজ করে ফেলেছে।
বিভিন্ন
প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের
ভিত্তিতে জানা যায় যে,
মালাকুল মউতের অনেক সাহায্যকারী ফেরেশতা
রয়েছে, তারা মালাকুল মউতের
পক্ষ হয়ে মানুষের রুহ
কবজ করে থাকেন।
হাদীসের
এক বর্ণনায় এসেছে, সকল প্রকার চতুষ্পদ
জন্তু জানোয়ার আল্লাহ্ তা'আলার যিকিরে
সর্বদা নিয়োজিত থাকে। যে সকল চতুষ্পদ
জানোয়ার যখনই আল্লাহ্ তা'আলার যিকির হতে
বিরত থাকবে, সাথে সাথে আল্লাহ্
তা'আলা ঐ সকল
চতুষ্পদ জানোয়ারকে জান কবজের নির্দেশ
দিয়ে থাকেন।
মৃত্যু অনিবার্য ও স্থান নির্ধারিত
যার যেখানে মৃত্যু হবে, সেস্থানে তার মৃত্যু নির্ধারিত এবং যেখানে তার কবর হওয়া নির্দিষ্ট আছে, সেস্থানেই তার কবর হবে। যদিও বা সে কোন দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করুক না কেন, আত্মা কবজের পূর্বে সে সেখানে পৌঁছবেই।
রিজিক কী হবে
কেননা আল্লাহ্ তা'আলা মালাকুল আরহাম নামক এক প্রকার ফেরেশতা সৃষ্টি করে রেখেছেন। শিশু মায়ের উদরে থাকাকলীন সময় ঐ ফেরেশতা আল্লাহর দরবারে আরজ করেন: হে আল্লাহ্! এ শিশুর গঠন, হায়াত, মউত ও রিজিক কী হবে? তখন আল্লাহ্ তা'আলা তাকে লক্ষ্য করে বলেন: তুমি লওহে মাহফুজে তাকিয়ে দেখ আমি তার ৫০০০০ বছর আগে এগুলো তার জন্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছি।.
তখন তার মৃত্যুর স্থানের কিছু মাটি এনে ঐ শিশুর শরীরের গঠনের সময় নাভিতে মিশিয়ে দেন। (আল-হাইছামী, মুসনাদে হারিস, ১খ., পৃ. ৩১৫। যাইনুদ্দীন আব্দুর রহীম, তাকরীবুল আসানীদ ওয়া তরতীবুল মাসানীদ, ১খ., পৃ. ৬৩। ছানাউল্লাহ পানিপথী, তাফসীরে মাযহারী।)
মৃত্যু সংঘটিত হয় যেখানে
ফলে
জন্মের পর মানুষ যে
জায়গায় ঘুরে বেড়াক না
কেন, মৃত্যুর আগে যেখান থেকে
রক্ত-মাংসের সাথে মিশ্রিত মাটি
নেয়া হয়েছিল, সেখানে এসে সে উপস্থিত
হয় এবং সেখানেই তার
মৃত্যু সংঘটিত হয়।
এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ ঘোষণা
হলো:
“হে
নবী! আপনি বলে দিন:
তোমরা যদি তোমাদের ঘরেও
থাকতে তবু যার যে
জায়গায় মৃত্যু (নির্ধারিত হয়ে আছে) তাকে
অবশ্যই সে জায়গাতেই পৌঁছতে
হবে।”
এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে যে, একদিন আজরাঈল আ. সুলাইমান আ.- এর দরবারে আসেন এবং সেখানে উপস্থিত এক সুশ্রী যুবককে দেখে তিনি তার দিকে খুব কঠোর দৃষ্টিতে তাকান। এতে যুবকটি ভয় পেয়ে গেল।
আজরাঈল আ. চলে যাওয়ার
পর যুবকটি সুলাইমান আ.-কে বলল
: হে আল্লাহর রাসূল! আমার অনুরোধ, আপনার
নির্দেশে বায়ু যেন আমাকে এখনই
চীন দেশে নিয়ে যায়।
যুবকটিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বায়ূ চীন দেশে নিয়ে
গেল।
পুনরায় আজরাঈল আ. সুলাইমান আ.- এর দরবারে আগমন করলে ঐ যুবকটির দিকে ঐভাবে তাকানোর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: আমি এ যুবকের আত্মা চীন দেশেই কবজ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।
সে ভয়ে আপনাকে
অনুরোধ করে তাকে চীন
দেশে পৌঁছে দেয়ার জন্য। আর আমি সেখানেই
তার রুহ কবজ করতে
পারবো।
মৃত্যুর তথ্য
গোপন
করার
রহস্য
মহান
আল্লাহ্ মৃত্যুর কথা মানুষের নিকট
থেকে গোপন করেছেন। এর
পেছনে কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। যেমন:
এক.
পৃথিবীর শৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য।
দুই.
মানুষকে নামায-রোযা ও অন্যান্য
ফরয কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়ার জন্য।
তিন.
২৪ ঘন্টা মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে থাকার জন্য।
মৃত্যুর যন্ত্রণা ও কবরের আজাব
হাদীসের
এক বর্ণনায় এসেছে, মূসা আ.-এর
ইন্তিকালের পর এক লোক
তাকে স্বপ্নে দেখে বলল:
হে
আল্লাহর নবী! আপনি কী
মৃত্যুর যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছেন? উত্তরে
মূসা আ. বললেন: আমার
মৃত্যুর সময় মনে হলো
কতকগুলো বিষাক্ত কাটা আমার কলিজার
মধ্যে ঢুকায়ে সমস্ত রগের মধ্যে পেঁচিয়ে
সমস্ত লোক একত্রিত হয়ে
টান দিলে যেমন কষ্ট
হয় তার চেয়ে মৃত্যুর
যন্ত্রণা আমার কাছে আরো
অধিক বেশি কষ্টের মনে
হয়েছে।
ঈসা আঃ এর একটি ঘটনা
অপর
এক বর্ণনায় এসেছে, ঈসা আ. একবার
এক কবরের নিকট যেয়ে বললেন:
“আল্লাহর নির্দেশে জীবিত হও। (যখন লোকটি আল্লাহর
নির্দেশে জীবিত হলো, তখন তিনি
তাকে জিজ্ঞেস করলেন) তুমি কে? তোমার
নাম কী? তখন লোকটি
বলল: আমার নাম সাম
ইবন নূহ।
তখন
ঈসা আ. তাঁকে কয়েকটি
প্রশ্ন করেছিলেন। তন্মধ্যে একটি হলো, তিনি
তাঁকে বললেন: আপনি কি আবারও
কবরে থাকতে চান, না দুনিয়াতে
থাকতে চান? তিনি বললেন:
হে আল্লাহর নবী ঈসা আ.!
আমি যদি এ দুনিয়ায়
আবার থেকে যাই তাহলে
কী আগের মৃত্যুর সময়
আজরাঈল যেমন আমার রুহ
কবজ
করেছে তেমন আবারও রুহ কবজ করবে? তখন ঈসা আ. বললেন: আপনি আল্লাহর পয়গম্বর। আপনি কেন আজরাঈলকে এত ভয় করেন? জবাবে সাম ইবন নূহ আ. বললেন: আপনার সাথে তো আর আজরাঈলের দেখা হয়নি এ জন্য এ মন্তব্য করছেন।
হে আল্লাহর নবী ঈসা আ.। আজ থকে
৪০০০ বছর পূর্বে আজরাঈল
আমার রুহ কবজ করেছিল
কিন্তু আমি আজও আমার
মৃত্যুর যন্ত্রণাকে ভুলতে পারিনি।
আস-সুয়ূতী, নূরুস সুদূর ফী আহওয়ালির কবর।
জালালুদ্দীন
আস-সুয়ূতী, জামিউল আহাদীস, ৭খ., পৃ. ৩৮১।
আহমাদ, কিতাবুয যুহুদ, পৃ. ২৩।
মৃত্যুর যন্ত্রণা
কত
কঠিন
আমাদের
প্রিয় নবী, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্
সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আল্লাহর নিকট পৃথিবীর অন্যান্য
সকল নবীদের থেকে অধিক প্রিয়।
হাদীসের বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে, আমাদের প্রিয়নবীর
রুহ যেদিন কবজ করা হয়
সেদিন জিব্রাঈল আ.- এর সাথে
আরেকজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর নিকট
আগমন করেন যার নাম
হলো মালাকুল মউত আজরাঈল আ.।
মালাকুল মউত আজরাঈল আঃ
জিব্রাঈল আ. রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর হুজরা মুবারকের দরজায় দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর নিকট অনুমতি নেয়ার পর তাঁকে বলেন: আল্লাহর নবী আজ আমি আপনার নিকট একজন নতুন ফেরেশতা সাথে নিয়ে এসেছি যে ইতিপূর্বে আপনার কাছে আর কোন দিন আসেনি।
তার নাম হলো
মালাকুল মউত আজরাঈল আ.। আজরাঈল আ.-কে অনুমতি দেয়ার
পর রাসূলুল্লাহ্ সা.-কে তিনি
বললেন: হে আল্লাহর রাসূল
সা.! আমি পৃথিবীতে ইতিপূর্বে সকল প্রাণির রুহ
কবজ করেছি কিন্তু কারো নিকট কোন
প্রকার অনুমতি প্রার্থনা করিনি। শুধু আমি আপনার
নিকট আপনার রুহ কবজ করার
জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছি।
রাসূলুল্লাহ্ সা. বললেন: যদি না দেই; তখন আজরাঈল আ. বললেন: তাহলে আমাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তখন জিব্রাঈল আ. বললেন: হে আল্লাহর রাসূল সা. অথচ আল্লাহ্ আপনার দীদারের অপেক্ষা করছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সা. তাঁকে রুহ কবজের অনুমতি দিলেন। ফাতেমা রা. তখন রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর কাছে অবস্থান করছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাঃ এর মৃত্যুর যন্ত্রণা
তিনি বলেন: আমি দেখলাম, মৃত্যুর যন্ত্রণার কারণে রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর হাত মুবারক একবার গুটিয়ে আসছে আরেকবার মেলে যাচ্ছে। এসময় তিনি একটি চাদর দ্বারা আবৃত ছিলেন। এরপর আমি চাদরটি উঠিয়ে দেখি রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর সমস্ত শরীরের প্রত্যেকটি লোমকূপের গোড়া থেকে ঘাম নির্গত হচ্ছে।
আজরাঈল আ. যখন রাসূলুল্লাহ্
সা.-এর রুহ কবজ
করার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর বুকের উপর
হাত রাখলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ সা.
বললেন: হে আজরাঈল! তুমি
তো আমার বুকে হাত
রেখেছ বলে মনে হচ্ছে
না আমার মনে হচ্ছে
তুমি আমার বুকে ওহুদ
পাহাড় চেপে ধরেছ।`
ইব্ন আব্বাস, তানবীরুল
মাকাবীস, ২খ., পৃ. ৩২৫।
আবুল
ফারাজ আব্দুর রহমান, জামিউল উলূম ওয়াল হুকুম,
১খ., পৃ. ৩৭০।
সংগৃহীতঃ মৃত্যুর পরে অনন্ত জীবন
লেখকঃ মুহাম্মদ ইকবাল কীলানী
পোস্ট ট্যাগঃ